দেশের অন্যতম বৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS) তাদের আর্থিক বর্ষ ২০২৪-২৫ (FY25)-এর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে সংস্থার সিইও কে. কৃত্তিবাসন-এর বার্ষিক পারিশ্রমিকের পরিমাণ ও সাম্প্রতিক কর্মী ছাঁটাই সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ পেতেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনা ও সমালোচনা।
সিইও কৃত্তিবাসনের পারিশ্রমিক ২৬.৫ কোটি টাকা
প্রতিবেদনে প্রকাশ, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে TCS-এর সিইও কৃত্তিবাসন মোট ২৬.৫ কোটি টাকা বেতন পেয়েছেন, যা গত বছরের তুলনায় ৪.৬ শতাংশ বেশি। তাঁর এই পারিশ্রমিকের মধ্যে রয়েছে —
মূল বেতন: ১.৩৯ কোটি টাকা
ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা: ২.১২ কোটি টাকা
কামিশন (প্রদর্শনভিত্তিক): ২৩ কোটি টাকা
এই বিশাল পারিশ্রমিক প্যাকেজ ঘিরে সামাজিক মাধ্যম এবং কর্পোরেট মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, বিশেষত এমন একটি সময়ে যখন সংস্থা বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে।
শীর্ষ নেতৃত্বের বেতন কাঠামো:
শুধু কৃত্তিবাসন নন, TCS-এর অন্যান্য শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিরাও উল্লেখযোগ্য পারিশ্রমিক পেয়েছেন। সংস্থার প্রাক্তন চিফ অপারেটিং অফিসার (COO) এন.জি. সুব্রমানিয়াম, যিনি মে ২০২৪-এ পদত্যাগ করেন, তিনি FY25 সালে ১১.৫৫ কোটি টাকা পেয়েছেন।
তাঁর বেতনের বিস্তারিত হল —
মূল বেতন: ৩০ লক্ষ টাকা
ভাতা ও সুবিধা: ৭.২৪ কোটি টাকা
কামিশন: ৪ কোটি টাকা
বোর্ড সদস্যদের মধ্যে, হ্যানি সোরেনসেন ও প্রদীপ কুমার খোসলার পারিশ্রমিক ছিল যথাক্রমে ২.৭৪ কোটি টাকা। স্বতন্ত্র পরিচালক কেকি মিস্ত্রি পেয়েছেন ৩.০৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে ছিল ৩ কোটি টাকা কামিশন এবং ৫.৭ লক্ষ টাকা সিটিং ফি।
TCS-এর চেয়ারম্যান এন. চন্দ্রশেখরন শুধুমাত্র ২.১ লক্ষ টাকা সিটিং ফি গ্রহণ করেছেন এবং কামিশন নেননি।
কর্মী ছাঁটাই ও AI-কেন্দ্রিক রূপান্তর:
এই আর্থিক প্রতিবেদন এমন এক সময়ে প্রকাশ পেল, যখন সংস্থাটি ঘোষণা করেছে যে তারা বিশ্বব্যাপী প্রায় ১২,২৬১ জন কর্মী ছাঁটাই করেছে। যা TCS-এর মোট কর্মীবাহিনীর প্রায় ২ শতাংশ। এই ছাঁটাই মূলত মাঝ ও উচ্চস্তরের কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে।
TCS জানিয়েছে, এই ছাঁটাই কোনো খরচ কমানো বা স্বয়ংক্রিয়তার (automation) ফল নয়। বরং কর্মী এবং কাজের ধরনের মধ্যে অসামঞ্জস্যতার ফল। কোম্পানির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ক্লায়েন্টদের চাহিদা দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং সেই অনুপাতে আমাদের কাজের ধরনও বদলাচ্ছে। AI ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে আমাদের মানব সম্পদ পুনরায় সংগঠিত করার প্রয়োজন পড়েছে।”
কর্মী মহলে অসন্তোষ:
TCS-এর এই ঘোষণা কর্মী মহলে ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রের বিভিন্ন সংগঠনে আলোড়ন তুলেছে। একদিকে সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, অন্যদিকে বহু দক্ষ কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন। এই বৈপরীত্য ঘিরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, “যেখানে কোম্পানি লাভে চলছে এবং শীর্ষ নেতৃত্ব কোটি কোটি টাকা নিচ্ছেন, সেখানে সাধারণ কর্মীদের ছাঁটাই কতটা ন্যায়সংগত?”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, Generative AI, machine learning, ও automation tools ব্যবহারের ফলে প্রযুক্তি শিল্পে এক বিশাল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। ফলে এমন পরিস্থিতিতে অনেক কর্মীর দক্ষতা ‘obsolete’ হয়ে পড়ছে। কোম্পানিগুলিও এখন কর্মী নিয়োগ বা রি-স্কিলিংয়ের পরিবর্তে নতুন প্রযুক্তিতে দক্ষ কর্মীদেরই পছন্দ করছে।
ভবিষ্যতের রূপরেখা:
TCS জানিয়েছে যে তারা ভবিষ্যতে কর্মীদের re-skilling ও upskilling-এর উপর জোর দেবে এবং এমন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে, যারা নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে প্রস্তুত। যদিও বাস্তবে কতজন কর্মীকে এই সুযোগ দেওয়া হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় IT শিল্পে এই ধরনের ছাঁটাই প্রক্রিয়া আরও বাড়তে পারে এবং AI প্রযুক্তির প্রসার যত বাড়বে, ততই এই ধরণের পুনর্গঠন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
TCS-এর FY25 প্রতিবেদন একদিকে যেমন শীর্ষ নেতৃত্বের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি দেখিয়েছে, অন্যদিকে AI ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের দোহাই দিয়ে কর্মী ছাঁটাইকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই দুই বিপরীতমুখী চিত্রই বড় প্রশ্ন তুলেছে কর্পোরেট দায়িত্ববোধ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। IT খাতে কর্মরত বহু মানুষের জন্য এটি একটি নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে — যেখানে দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত অভিযোজন ক্ষমতা-ই টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।