ভারতের শেয়ার বাজার (Stock Market) মঙ্গলবার সকালে উচ্চমুখী প্রবণতার সঙ্গে শুরু হলেও, দিনের শেষে এটি তার প্রাথমিক লাভ হারিয়ে নেগেটিভ অঞ্চলে চলে যায়। বিএসই সেনসেক্স ২৪০ পয়েন্ট (০.২৯%) বেড়ে ৮১,৬১৪-এ পৌঁছেছিল, যেখানে নিফটি ৪০ পয়েন্ট (০.১৬%) বৃদ্ধি পেয়ে ২৪,৭৫৭-এ দাঁড়িয়েছিল। তবে, দিনের শেষে সেনসেক্স ২০০ পয়েন্ট কমে এবং নিফটি ২৪,৭০০-এর নিচে নেমে যায়। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতীয় শেয়ার বাজারের সর্বশেষ আপডেট, বৈশ্বিক প্রভাব এবং ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ারের পতনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
ভারতীয় বাজারের গতিবিধি
ভারতীয় শেয়ার বাজার বর্তমানে একটি সংহতকরণ পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকেতের উপর নির্ভর করে তাদের কৌশল ঠিক করছে। ব্রডার মার্কেটে, নিফটি মিডক্যাপ এবং স্মলক্যাপ সূচক যথাক্রমে ০.১২% এবং ০.১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। সেক্টরের মধ্যে নিফটি ব্যাঙ্ক সূচক একটি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, ৫৬,১৬১-এ উঠে পূর্ববর্তী শীর্ষ ৫৬,০৯৮.৭০-কে ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে, নিফটি আইটি, মেটাল এবং রিয়েলটি সূচক ০.৩% থেকে ০.৫% পর্যন্ত লাভ করেছে। তবে, নিফটি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক সূচক ০.৩% হ্রাস পেয়েছে।
বাজারের প্রধান হাইলাইটগুলোর মধ্যে ছিল ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ারের ৫% পতন, যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই পতনের পেছনে বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) খাতে বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার প্রভাব থাকতে পারে। এছাড়া, অ্যাডানি গ্রুপের শেয়ারগুলোও পতনের মুখ দেখেছে, যা বাজারের অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বৈশ্বিক বাজারের প্রভাব
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বাজারগুলো মঙ্গলবার সকালে ওয়াল স্ট্রিটের রাতের লাভের প্রভাবে কিছুটা উচ্চমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে। তবে, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা বাজারের উপর প্রভাব ফেলছে। চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে যে তারা একটি অস্থায়ী বাণিজ্য চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, বরং ওয়াশিংটনকে চুক্তি মেনে না চলার জন্য দায়ী করেছে। এই বাক্যবিনিময় বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার আরও অবনতির ইঙ্গিত দেয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউএস) প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইস্পাতের উপর ৫০% শুল্ক দ্বিগুণ করার পরিকল্পনার সমালোচনা করেছে, যা ব্রাসেলস এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে চলমান আলোচনাকে ‘ক্ষুণ্ণ’ করবে বলে সতর্ক করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা এর জবাবে ‘প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা’ নিতে প্রস্তুত। এই বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা ভারতীয় বাজারের উপরও প্রভাব ফেলছে, বিশেষ করে মেটাল এবং আইটি খাতে।
এশিয়ার বাজারে, জাপানের নিক্কেই সূচক ০.৪৩% বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে টপিক্স এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কসপি সূচক স্থিতিশীল ছিল। অস্ট্রেলিয়ার এএসএক্স ২০০ সূচক ০.৬৭% বেড়েছে। তবে, চীনে কাইক্সিন ম্যানুফ্যাকচারিং পিএমআই মে মাসে ৪৮.৩০-এ নেমে এসেছে, যা এপ্রিলের ৫০.৪০ থেকে উল্লেখযোগ্য হ্রাস এবং উৎপাদন খাতে সংকোচনের ইঙ্গিত দেয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারগুলো ভোটের দিন উপলক্ষে বন্ধ ছিল।
মার্কিন বাজারে, সোমবার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ০.৪১% বৃদ্ধি পেয়েছে, নাসডাক কম্পোজিট ০.৬৭% এবং ডাউ জোন্স ০.০৮% বেড়েছে। এই লাভগুলো প্রযুক্তি খাতের শক্তিশালী পারফরম্যান্সের দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল।
ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ার পতন
ওলা ইলেকট্রিক, ভারতের বৈদ্যুতিক যানবাহন খাতের একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি, মঙ্গলবার তার শেয়ার মূল্যে ৫% পতনের সম্মুখীন হয়েছে। এই পতনের পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা এবং মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাবে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ইভি উৎপাদনের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ইভি খাতে সতর্কতার মনোভাব দেখা যাচ্ছে, কারণ বাজারের অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তাদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহিত করছে।
বাজারের দিকনির্দেশনা এবং বিশ্লেষণ
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, ভারতীয় শেয়ার বাজার বর্তমানে একটি সংহতকরণ পথে রয়েছে। নিফটি ২৪,৫০০ থেকে ২৫,০০০-এর মধ্যে একটি সীমাবদ্ধ রেঞ্জে ঘুরছে। এই রেঞ্জ থেকে ব্রেকআউট বা ব্রেকডাউন নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব নয়। মিডক্যাপ এবং স্মলক্যাপ স্টকগুলোতে বেশিরভাগ বাজারের গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা আয়ের ফলাফলের দ্বারা চালিত হচ্ছে। তবে, বিনিয়োগকারীদের মূল্যায়ন ছাড়া মিড এবং স্মলক্যাপে বিনিয়োগের তাড়া এড়ানো উচিত। গুণগত স্টকগুলো এখনও এই সেগমেন্টে ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারে।
নিফটি ব্যাঙ্ক সূচকের রেকর্ড উচ্চতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি করেছে, বিশেষ করে পিএসইউ ব্যাঙ্কগুলোর সম্পদের গুণমান উন্নতি এবং বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে। তবে, আইটি, মেটাল এবং রিয়েলটি খাতে অস্থিরতা বাজারের সামগ্রিক পারফরম্যান্সের উপর প্রভাব ফেলছে।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ভারতীয় বাজারের দিকনির্দেশনা নির্ভর করছে কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার ফলাফল বাজারের মনোভাব নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দ্বিতীয়ত, ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক তথ্য, যেমন জিডিপি বৃদ্ধির হার এবং মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রভাবিত করবে। তৃতীয়ত, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) আসন্ন মুদ্রানীতি সভা, যেখানে সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে, বাজারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত হতে পারে।
ভারতীয় শেয়ার বাজার ৩ জুন, ২০২৫-এ একটি অস্থির দিন পার করেছে, যেখানে প্রাথমিক লাভের পর সেনসেক্স এবং নিফটি নেগেটিভ অঞ্চলে শেষ হয়েছে। ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ারের ৫% পতন এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সতর্কতা সৃষ্টি করেছে। তবে, নিফটি ব্যাঙ্ক সূচকের রেকর্ড উচ্চতা এবং মিডক্যাপ ও স্মলক্যাপ সূচকের কিছুটা লাভ বাজারে কিছু ইতিবাচকতা যোগ করেছে। বিনিয়োগকারীদের উচিত বৈশ্বিক ও দেশীয় সংকেতগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ কৌশল অনুসরণ করা। আপনার বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যোগ্য আর্থিক উপদেষ্টার পরামর্শ নিন এবং বাজারের সর্বশেষ আপডেটের সঙ্গে নিজেকে আপডেটেড রাখুন।