শুক্রবার দেশীয় শেয়ারবাজারে (Stock Market) প্রবল অস্থিরতা দেখা গেল। দিনের শুরুতে সামান্য সবুজে খোলা বাজার দুপুরের পর থেকে দোলাচলে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বিকেলের ট্রেডিং সেশনে পতনের দিকেই গতি বাড়ে। সপ্তাহের শেষ দিনে বিএসই সেনসেক্স ২৫০ পয়েন্টেরও বেশি হ্রাস পেয়ে ৭৯,৮১০-এ থামে। অপরদিকে, এনএসই নিফটি৫০ ৭৪ পয়েন্ট কমে ২৪,৪৩৫-এ সেশন শেষ করে। অর্থাৎ, টানা দ্বিতীয় দিন পতনের স্রোতে ভেসে গেল ভারতের শেয়ারবাজার।
শুক্রবার সেনসেক্সের অন্তর্গত কিছু শেয়ার অবশ্য সবুজে দিন শেষ করে। এর মধ্যে আইটিসি, বিএইএল, ট্রেন্ট, এলঅ্যান্ডটি এবং কোঠাক মহিন্দ্রা ব্যাংক কিছুটা লাভ দেয় বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু বাজারের ভার টেনে নামায় মহিন্দ্রা অ্যান্ড মহিন্দ্রা, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইনফোসিস, এনটিপিসি ও টাটা মোটরসের মতো শীর্ষ কোম্পানি। ভারী ওজনদার এই শেয়ারের পতন সূচকের সামগ্রিক গতি কমিয়ে দেয়।
বৃহত্তর বাজারেও চাপের ছবিই ধরা পড়েছে। নিফটি মিডক্যাপ সিলেক্ট সূচক ০.৬৮ শতাংশ কমেছে। সেক্টরভিত্তিকভাবে দেখলে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে রিয়েলটি (১.৩৩% পতন) এবং তেল ও গ্যাস সূচক (১.০১% পতন)। অন্যদিকে, প্রতিরোধ গড়ে বাজারকে কিছুটা সামলে রেখেছে এফএমসিজি সূচক, যা এদিন ০.৯৫ শতাংশ বেড়েছে।
বাজার বিশ্লেষকদের মতে, এদিনের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত। চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি থেকে কার্যকর হয়েছে ভারতের পণ্যের উপর অতিরিক্ত শুল্ক। বিশেষত, নির্দিষ্ট কিছু রপ্তানি পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যারিফ চাপানো হয়েছে, ফলে মোট শুল্কের হার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের মনে বড়সড় অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। পাশাপাশি, ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি নিয়েও আমেরিকার অসন্তোষ বাজারে চাপ বাড়িয়েছে।
তবে এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ভারত সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত। নয়া দিল্লি জানিয়েছে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে প্রস্তাবিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (Bilateral Trade Agreement) নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করার ব্যাপারে তারা আশাবাদী। তবে ভারতীয় পক্ষ স্পষ্ট জানিয়েছে, উচ্চ শুল্ক কমানো বা প্রত্যাহারই হবে আলোচনার অন্যতম প্রধান শর্ত। যদিও বৈঠকের নতুন দিনক্ষণ এখনও ঘোষণা হয়নি।
শুক্রবার সকালে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীলভাবে বাজার খোলে। সেনসেক্স ৮০,১৫০-এর উপরে ৫০ পয়েন্ট লাভ নিয়ে শুরু করে, নিফটি সামান্য ১১ পয়েন্ট বেড়ে ২৪,৫০০ ছাড়ায়। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের টানা বিক্রির চাপ দুপুরের পর বাজারকে নিম্নমুখী করে দেয়। এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, এদিন Foreign Institutional Investors (FIIs) প্রায় ৩,৮৫৬.৫১ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করেছে। বিপরীতে, Domestic Institutional Investors (DIIs) নেট ক্রেতা হিসেবে বাজারে ছিল এবং তারা প্রায় ৬,৯২০.৩৪ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে।
এর আগের দিন, বৃহস্পতিবারও বাজারে বড়সড় পতন দেখা গিয়েছিল। বৈশ্বিক বাজারে দুর্বলতা, টানা বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার এবং নতুন শুল্ক আরোপের কারণে সূচক একেবারে ভেঙে পড়ে। সেদিন সেনসেক্স প্রায় ৭০৬ পয়েন্ট নামতে নামতে ৮০,০৮০-এ এসে থামে। একই দিনে নিফটি ২১১ পয়েন্ট হারিয়ে ২৪,৫০০-র ঠিক ওপরে ২৪,৫০০.৯০-এ শেষ করে।
এদিকে, মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলির মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল সেক্টর। এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র সরকার রপ্তানিকারকদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পদক্ষেপ নিয়েছে। শুক্রবার সরকার ঘোষণা করেছে যে, তুলো আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আগামী ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে টেক্সটাইল শিল্প কিছুটা সাপোর্ট পাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন শিল্প মহল। বিশেষজ্ঞদের মতে, কাঁচামালের দামে স্বস্তি মিললে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় ভারতীয় টেক্সটাইল কিছুটা সুবিধা পাবে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিনিয়োগকারীদের এখন দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাবই বাজারের অস্থিরতার মূল কারণ। একদিকে মার্কিন শুল্ক বাড়ার ফলে রপ্তানি-নির্ভর কোম্পানিগুলির উপর চাপ বাড়ছে, অন্যদিকে বিদেশি তহবিল প্রত্যাহারের কারণে বাজারে তারল্য কমছে। যদিও দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা (DIIs) সক্রিয়ভাবে বাজারকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অস্থিরতা চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে বাজারের দৃষ্টি থাকবে দুটি বিষয়ে—
1. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতি।
2. বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তহবিল প্রবাহের গতি।
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার যদি শুল্ক সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারে এবং বৈশ্বিক বাজারে স্থিতিশীলতা আসে, তাহলে শেয়ারবাজার ফের চাঙ্গা হতে পারে। তবে আপাতত বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার পরামর্শই দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।