সোমবার বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য শুল্ক যুদ্ধ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কার ফলে শেয়ারবাজারে ব্যাপক ধস (Stock Market Crash in India) নামে। ভারতের শেয়ারবাজারও এর প্রভাব থেকে রেহাই পায়নি। দিনের শুরুতেই বাজারে প্রায় ৪ শতাংশ পতন দেখা যায়। BSE সেনসেক্স প্রায় ৩,০০০ পয়েন্ট পড়ে যায় এবং NSE নিফটি ২২,০০০-র নিচে নেমে আসে। এই ধসে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ১৬ লাখ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে “চরম অনিশ্চয়তার সময়” বলে উল্লেখ করেছেন এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে তারা এটিকে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের সুযোগ বলেও অভিহিত করেছেন, বিশেষত সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা SIP শুরু করার জন্য এটি ‘আদর্শ সময়’ বলে মনে করছেন।
বাজারের বর্তমান অবস্থা: কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
জিওজিত ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস-এর চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট ভি কে বিজয়কুমার বলেন, “এই মুহূর্তে বিশ্ববাজারে যে অস্থিরতা চলছে, তার মূল কারণ হল আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি। এটি কীভাবে বিকশিত হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ স্ট্র্যাটেজিই সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত।”
মাস্টার ক্যাপিটাল সার্ভিসেস-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভাইজরি) বিষ্ণু কান্ত উপাধ্যায় বলেন, “বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় বাজারে অস্থিরতা আগামী কিছুদিন চলতেই থাকবে। তবে বর্তমান স্তরে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ভালো সুযোগ রয়েছে।”
VSRK ক্যাপিটালের ডিরেক্টর স্বপনিল আগরওয়াল জানান, “মন্দার আশঙ্কার মাঝেও ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সতর্কতা অবলম্বন করুন, তবে আতঙ্কিত হবেন না। এই মুহূর্তে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা জরুরি।”
বিনিয়োগের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
স্বপনিল আগরওয়াল বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্যে তিনটি বিষয় মনে রাখার পরামর্শ দেন—
১. ট্রাম্পের এই ‘অযৌক্তিক’ শুল্কনীতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
২. ভারতের জিডিপিতে মার্কিন রপ্তানির অংশ মাত্র ২ শতাংশ, ফলে ভারতের আর্থিক প্রবৃদ্ধিতে এর প্রভাব সীমিত।
৩. ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, যা সফল হলে ভারতের উপর শুল্কের প্রভাব কমবে।
কোন সেক্টরে ফোকাস করবেন?
ভি কে বিজয়কুমার বলেন, “দেশীয় চাহিদাভিত্তিক সেক্টর যেমন ফিনান্সিয়ালস, এভিয়েশন, হোটেল, বাছাই করা অটো কোম্পানি, সিমেন্ট, প্রতিরক্ষা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকবে। ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করবেন না বলেই আশা করা যাচ্ছে, ফলে এই খাত স্থিতিশীল থাকবে।”
বিষ্ণু কান্ত উপাধ্যায়ও মনে করেন ফাইন্যান্স, অয়েল অ্যান্ড গ্যাস, কনজাম্পশন এবং FMCG সেক্টরগুলো দীর্ঘমেয়াদে স্থিরতা দিতে পারে।
স্বপনিল আগরওয়ালও বলেন, “বর্তমানে FMCG, ফার্মা ও ফিনান্স খাতগুলো অন্যান্য খাতের তুলনায় বেশি স্থিতিশীলতা দেখাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এই খাতে ফোকাস করাই হবে লাভজনক।”
SIP শুরুর জন্য আদর্শ সময়
স্বপনিল আরও বলেন, “দীর্ঘমেয়াদি ডাইভার্সিফিকেশনের জন্য নিফটি জুনিয়র (নিফটি নেক্সট ৫০) এবং নিফটি ETF একটি ভালো অপশন। যদিও স্বল্পমেয়াদে কিছুটা ওঠানামা থাকতে পারে। এই মুহূর্তে SIP শুরু করার জন্য একেবারে সঠিক সময়—যা ভবিষ্যতের জন্য সম্পদ গঠনে সহায়ক হবে।”
মিরায় অ্যাসেট ক্যাপিটাল মার্কেটস-এর চিফ স্ট্র্যাটেজি অফিসার মানস জৈন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “ভারতের দীর্ঘমেয়াদি গল্প এখনও অটুট। FY25 সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ২০২৪-২৫ থেকে ২০৩০-৩১ পর্যন্ত ঋণ-জিডিপি অনুপাত অন্তত ৫.১ শতাংশ কমে যাবে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ভারত ভবিষ্যতে একটি ‘সেফ হ্যাভেন’ হয়ে উঠতে পারে।”
বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য একদিকে যেমন উদ্বেগের কারণ, অন্যদিকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ সুযোগও। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কভাবে ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে এই পরিস্থিতি থেকে লাভবান হওয়া সম্ভব।