গ্যাংটক, ৬সেপ্টেম্বর ২০২৫: ভাষা কেবলমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি এক রাজ্যের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেই দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিল কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক্ষুদ্রতম রাজ্য সিকিমে (Sikkim) টেলিকম পরিষেবায় নেপালি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হলো। ২ সেপ্টেম্বর Department of Telecommunications (DoT)-এর জারি করা এক অফিসিয়াল মেমোরান্ডামে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশনার মূল দিকনির্দেশনা
১. নেপালি ভাষার অন্তর্ভুক্তি:
এখন থেকে সিকিমে (Sikkim) কার্যরত সব টেলিকম অপারেটরদের গ্রাহকসেবা, SMS সতর্কতা, কল-ভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় সাড়া (IVRS) ইত্যাদি ক্ষেত্রে নেপালি ভাষা ব্যবহার করতে হবে। ইংরেজি ও হিন্দি যেমন চালু থাকবে, তেমনি নেপালি প্রতিটি সেবা প্ল্যাটফর্মে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
২. মেয়াদ ও প্রতিপালন:
DoT-এর নির্দেশ অনুযায়ী, টেলিকম অপারেটরদের আগামী ৩০ দিনের মধ্যে এই পরিবর্তন কার্যকর করতে হবে। অর্থাৎ অক্টোবর ২০২৫-এর প্রথম সপ্তাহ থেকেই গ্রাহকরা নেপালি ভাষায় টেলিকম পরিষেবা ব্যবহার করতে পারবেন।
৩. নজরদারি ও প্রয়োগ:
সরকার জানিয়েছে, এই নিয়ম মানতে কোনো টেলিকম সংস্থা গাফিলতি করলে তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রয়োজন হলে জরিমানা কিংবা লাইসেন্স সংক্রান্ত সতর্কতা জারি করতেও পিছপা হবে না কর্তৃপক্ষ।
কেন এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ?
ভাষার মর্যাদা ও অংশগ্রহণ
সিকিমে (Sikkim) নেপালি ভাষা দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে প্রচলিত ও বোধগম্য ভাষা। স্থানীয় মানুষ তাঁদের মাতৃভাষাকে প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে চাইছিলেন বহুদিন ধরে। এবার সেই দাবিই স্বীকৃতি পেল।
মাতৃভাষায় পরিষেবা পাওয়ার অভিজ্ঞতা
গ্রাহক সেবায় মাতৃভাষার ব্যবহার সাধারণ মানুষকে আরও স্বচ্ছন্দ করবে। বিশেষ করে জরুরি অবস্থায়, যেমন—প্রাকৃতিক দুর্যোগের সতর্কতা, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বার্তা বা সরকারি জরুরি বিজ্ঞপ্তি—সবকিছু মাতৃভাষায় পেলে দ্রুত বোধগম্য হবে।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও সংহতি
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগ আরও মজবুত হবে। স্থানীয় ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে রাজ্যের মানুষের আত্মপরিচয় ও সম্মান রক্ষা করা। তবে সমালোচকেরা বলছেন, একদিকে এটি যথার্থ স্বীকৃতি হলেও অন্যদিকে “বিদেশি ভাষা” হিসেবে নেপালির প্রাধান্যকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্কও শুরু হতে পারে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট নেপালি ভাষাকে ভারতের সংবিধানের অষ্টম সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সময় থেকেই নেপালি ভাষা ভারতের অন্যতম সরকারি স্বীকৃত ভাষা হয়ে ওঠে। সিকিমে (Sikkim) নেপালির পাশাপাশি ভূটিয়া, লেপচা ও অন্যান্য ভাষাও সরকারি স্বীকৃতি পায়, কিন্তু ব্যবহার ও প্রচারে নেপালিই শীর্ষে রয়েছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
রাজ্য সরকার এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে। সিকিমের (Sikkim) মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, “আমাদের মানুষের মাতৃভাষায় যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হওয়া সত্যিই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।” স্থানীয় সংগঠনগুলোও এই উদ্যোগকে সমর্থন করছে। তবে কিছু মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে—নেপালি যেহেতু একটি “বিদেশি উৎসের ভাষা”, সেটিকে কি বাংলার মতো অন্যান্য প্রতিবেশী ভাষার উপর প্রাধান্য দেওয়া উচিত? এ নিয়ে আগামী দিনে আলোচনা চলবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপের ফলে গ্রাহক সন্তুষ্টি যেমন বাড়বে, তেমনি টেলিকম সংস্থাগুলিও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। শুধু তাই নয়, এই উদাহরণ অন্য রাজ্যগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে, যেখানে আঞ্চলিক ভাষাকে গ্রাহকসেবায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
সিকিমে (Sikkim) টেলিকম পরিষেবায় নেপালি ভাষার বাধ্যতামূলক ব্যবহার নিছক প্রযুক্তিগত নির্দেশ নয়; এটি আসলে স্থানীয় সংস্কৃতিকে মর্যাদা দেওয়ার পদক্ষেপ। সরকারের এই ভাষাবান্ধব নীতি সঠিকভাবে কার্যকর হলে শুধু যোগাযোগ সহজ হবে না, রাজ্যের মানুষের সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্কও আরও দৃঢ় হবে। ভবিষ্যতে এই নীতি ভারতের বহুভাষিক পরিচয়কে আরও সুসংহত করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।