সাধারণ বেতনভুক্ত কর্মচারীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড (Provident Fund) হল অবসরের পরের জীবনের আর্থিক সুরক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। চাকরিজীবনের প্রতিটি মাসে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের অবদানে গড়ে ওঠে এই সঞ্চয়, যার ওপর সরকার নির্ধারিত সুদ যুক্ত হয় নিয়মিত। বর্তমানে এই সুদের হার ৮.২৫ শতাংশ, যা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ের জন্য এক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রেপো রেট বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে হোম লোনের ইএমআই বেড়েছে অনেকটাই। ফলে বহু মানুষ দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ ও উচ্চ কিস্তির বোঝা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর ফলে অনেক বেতনভুক্ত ঋণগ্রহীতা ভাবতে শুরু করেছেন তাঁদের পিএফ টাকা দিয়ে হয়তো হোম লোন শোধ করে ফেলা ভালো হবে। ঋণমুক্ত হওয়ার লোভনীয় ভাবনাটি স্বাভাবিক হলেও, এটি সঠিক সিদ্ধান্ত কি না, তা নির্ভর করে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর—আপনার বয়স, আয়, অবসরের সময়কাল এবং আর্থিক পরিকল্পনার ওপরে।
পিএফ হলো অবসরের জন্য পরিকল্পিত সঞ্চয়:
প্রভিডেন্ট ফান্ড মূলত অবসরের সময় আপনার জীবিকার নিরাপত্তা দেয়। এটি একটি কর-মুক্ত, সুদবহি সঞ্চয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায়। হোম লোন শোধ করতে গিয়ে এই সঞ্চয়ে হস্তক্ষেপ করলে ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হতে পারে।
যদিও অতিরিক্ত কিছু টাকা দিয়ে ঋণ দ্রুত শোধ করা আর্থিকভাবে লাভজনক বলে মনে হতে পারে, পিএফ-এর ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু আলাদা। কারণ এটি “সারপ্লাস” অর্থ নয়, বরং আপনার বার্ধক্যের রক্ষণাবেক্ষণের মূল ভরসা।
পিএফ তুলে হোম লোন শোধের নিয়ম কী বলে?
বর্তমান ইপিএফও (EPFO) নিয়ম অনুযায়ী, পিএফ টাকা আপনি হোম লোন নেওয়ার জন্য, বাড়ি কেনার সময় ডাউন পেমেন্টে, নতুন বাড়ি নির্মাণে অথবা চলতি হোম লোন শোধ করতে ব্যবহার করতে পারেন। তবে এর জন্য কমপক্ষে পাঁচ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এই নিয়মে আপনি আপনার পিএফ-এর ৯০ শতাংশ পর্যন্ত তুলতে পারেন। প্রয়োজন হলে স্বামীর বা স্ত্রীর পিএফের সঙ্গে একত্রে করেও এই টাকা ব্যবহার করা যেতে পারে। এর ফলে আপনি আপনার ঋণের ইএমআই কমাতে পারেন, ঋণের মেয়াদ ছোট করতে পারেন কিংবা কোনো অতিরিক্ত টপ-আপ ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন এড়াতে পারেন।
কর সংক্রান্ত নিয়ম:
যদি আপনি পাঁচ বছরের চাকরির পর পিএফ তুলেন, তবে সেই টাকা করমুক্ত হয়। তবে যদি আপনার বাৎসরিক পিএফ অবদান ₹২.৫ লক্ষের বেশি হয়, তাহলে সেই অতিরিক্ত অংশের ওপর অর্জিত সুদ করযোগ্য হয়ে যায়। আর যদি আপনি এমন কোনো সংস্থায় চাকরি করেন যেখানে নিয়োগকর্তা কোনো অবদান রাখেন না, সেক্ষেত্রে এই সীমা ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
তাই টাকা তোলার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনি কর ছাড়ের নিয়মের আওতায় পড়ছেন কি না।
পিএফ তুলে কী হারাতে পারেন?
পিএফ থেকে টাকা তুলে ঋণ শোধ করলে আপনি শুধু আপনার সঞ্চয়ই হারাচ্ছেন না, বরং ভবিষ্যতের নিরাপত্তার একটি বড় সহায়ককে হ্রাস করছেন। বার্ধক্যের সময় চিকিৎসা ব্যয় এবং দৈনন্দিন খরচ দিন দিন বাড়ছে। এছাড়াও আপনি হারাচ্ছেন কর-মুক্ত সুদের সুবিধা, যা অন্যান্য কোনো বিনিয়োগে পাওয়া কঠিন।
পিএফ আর্থিক জরুরি অবস্থার সময় একটি বাফার হিসেবেও কাজ করে। হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়া, অসুস্থতা, বা অন্যান্য অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম নিরাপদ আশ্রয়। এখন এই বাফার খরচ করে ফেললে ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকি বাড়ে।
কবে এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে?
যদি আপনি অবসরের একেবারে কাছাকাছি থাকেন এবং তখনো বড় অঙ্কের হোম লোন বাকি থাকে যার সুদের হার পিএফের সুদের চেয়েও বেশি, তাহলে এই ক্ষেত্রে পিএফ টাকা ব্যবহার করে ঋণ শোধ করা যৌক্তিক হতে পারে। এতে আপনার অবসরের পর মাসিক ব্যয়ের বোঝা কমবে।
তবে যদি আপনি অপেক্ষাকৃত তরুণ হন, নিয়মিত আয় করছেন এবং ইএমআই মেটাতে পারছেন, তাহলে পিএফ তুলে ঋণ শোধ করার প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতের জন্য একটি সুনিশ্চিত অবসরকালীন সঞ্চয় অনেক সময় সুদের অল্প কিছু বাঁচানোর চেয়ে বেশি মানসিক শান্তি এনে দিতে পারে।
কী করবেন?
আপনার আর্থিক পরিকল্পনার আলোকে পিএফ ব্যবহার করুন। একবার পিএফ থেকে টাকা তুলে ফেললে তা পুনরুদ্ধার করা কঠিন। বিকল্প হিসাবে আপনি ধীরে ধীরে ইএমআই বাড়াতে পারেন, একটি রিডাকশন-ফোকাসড SIP শুরু করতে পারেন, বা ঋণের পুনঃবিন্যাস (refinancing) বিবেচনা করতে পারেন।
সর্বোপরি, প্রভিডেন্ট ফান্ডকে একটি চূড়ান্ত বিকল্প হিসেবে দেখুন। আর্থিক পরিকল্পনায় সাময়িক চাপ এলেও ভবিষ্যতের সুরক্ষা যেন তার বলি না হয়।