ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (SEBI) মিউচুয়াল ফান্ড খাতে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংস্থাটি ঘোষণা করেছে যে, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (AMC) গুলি আর মিউচুয়াল ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটরদের কোনও ধরনের লেনদেন-ভিত্তিক কমিশন বা ট্রানজ্যাকশন চার্জ প্রদান করবে না। এই সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে।
সিদ্ধান্তের পটভূমি:
SEBI তাদের ২৭ জুন ২০২৪ তারিখের মাস্টার সার্কুলার ফর মিউচুয়াল ফান্ডস–এ একটি ধারা রেখেছিল যেখানে বলা হয়েছিল, AMC-রা ন্যূনতম ১০,০০০ টাকার সাবস্ক্রিপশন নিয়ে আসা ডিস্ট্রিবিউটরদের ট্রানজ্যাকশন চার্জ দিতে পারবে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে SEBI জনমত গ্রহণ ও শিল্পক্ষেত্রের ফিডব্যাক বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই বিধান আর বহাল থাকবে না।
সার্কুলারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে— “শিল্পক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত মতামত এবং এই বিষয়টি বিবেচনা করে যে ডিস্ট্রিবিউটররা AMC-র এজেন্ট হিসাবে কমিশন পাওয়ার অধিকারী, মাস্টার সার্কুলারের প্যারাগ্রাফ ১০.৪.১.বি এবং ১০.৫ অনুযায়ী নির্ধারিত চার্জ বা কমিশন বাতিল করা হলো।”
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি কী?
একটি AMC হল SEBI-নিবন্ধিত সংস্থা যা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে এবং সেই অর্থ বিভিন্ন সম্পদশ্রেণিতে (যেমন ইকুইটি, ঋণপত্র, মানি মার্কেট ইন্সট্রুমেন্ট ইত্যাদি) বিনিয়োগ করে। AMC-র পক্ষে এই বিনিয়োগের প্রচার ও বিক্রয় কাজ করে থাকেন মিউচুয়াল ফান্ড ডিস্ট্রিবিউটররা।
কেন এই পরিবর্তন?
SEBI-র মতে, এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য হল কমিশন প্রদানের পদ্ধতিকে আরও স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং বিনিয়োগকারী-বান্ধব করা। কমিশন কাঠামোতে পরিবর্তন এনে SEBI চায়—
বিনিয়োগকারীর ওপর অপ্রয়োজনীয় চার্জ কমাতে,
ডিস্ট্রিবিউটরদের আয়ের উৎসকে পারফরম্যান্স-লিঙ্কড বা দীর্ঘমেয়াদি সেবার দিকে সরাতে,
AMC-র প্রণোদনা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়াতে।
বিনিয়োগকারীদের উপর প্রভাব:
এই সিদ্ধান্তে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য কয়েকটি ইতিবাচক দিক রয়েছে—
1. খরচ সাশ্রয়: আগে বিনিয়োগের সময় AMC-রা ডিস্ট্রিবিউটরদের কমিশন দেওয়ার খরচ পণ্যের খরচে অন্তর্ভুক্ত করত। কমিশন তুলে দেওয়া হলে বিনিয়োগকারীর জন্য মার্জিনাল খরচ কিছুটা কমতে পারে।
2. স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: বিনিয়োগকারীরা সহজেই বুঝতে পারবেন তাদের বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত চার্জের পরিমাণ।
3. দীর্ঘমেয়াদি লাভের সম্ভাবনা: খরচ কমে গেলে দীর্ঘমেয়াদে রিটার্নের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ডিস্ট্রিবিউটরদের জন্য চ্যালেঞ্জ:
তবে এই সিদ্ধান্ত ডিস্ট্রিবিউটরদের জন্য একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
আয়ের কাঠামোতে পরিবর্তন: আগের মতো নির্দিষ্ট লেনদেনভিত্তিক কমিশন না পাওয়ায় আয়ের ধারা পরিবর্তিত হবে।
সেবার মানে জোর: এখন তাদের আয় নির্ভর করতে পারে পরামর্শ সেবা, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক রক্ষা এবং ক্লায়েন্ট ধরে রাখার ক্ষমতার ওপর।
নতুন ব্যবসায়িক মডেল প্রয়োজন: অনেক ডিস্ট্রিবিউটরকে ফি-ভিত্তিক অ্যাডভাইজরি বা পারফরম্যান্স-ভিত্তিক কমিশন মডেল গ্রহণ করতে হতে পারে।
শিল্পক্ষেত্রের প্রতিক্রিয়া:
মিউচুয়াল ফান্ড ইন্ডাস্ট্রিতে এই সিদ্ধান্তকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছে। কিছু AMC ও বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী মনে করছে, সিদ্ধান্তটি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারী-বান্ধব হবে এবং স্বচ্ছতা বাড়াবে। অন্যদিকে, কিছু ডিস্ট্রিবিউটর মনে করছেন, এতে তাদের আয়ের ওপর চাপ বাড়বে এবং ছোট বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ:
এই পরিবর্তনের ফলে মিউচুয়াল ফান্ড বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু বড় পরিবর্তন আসতে পারে—
1. পরামর্শ-ভিত্তিক সেবা বৃদ্ধি: ডিস্ট্রিবিউটররা আরও পেশাদার আর্থিক উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারেন।
2. ডিজিটাল চ্যানেলের প্রসার: অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সরাসরি বিনিয়োগের প্রবণতা বাড়তে পারে, যেহেতু খরচ তুলনামূলকভাবে কম।
3. প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: AMC-রা ডিস্ট্রিবিউটরদের আকর্ষণ করার জন্য নতুন ধরনের প্রণোদনা কাঠামো চালু করতে পারে।
SEBI-র এই সিদ্ধান্ত মিউচুয়াল ফান্ড শিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বচ্ছতা ও খরচ সাশ্রয়ের সুযোগ তৈরি করবে, তবে ডিস্ট্রিবিউটরদের জন্য ব্যবসায়িক মডেলে পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসবে। সামগ্রিকভাবে, এটি ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ড বাজারকে আরও স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও বিনিয়োগকারী-কেন্দ্রিক করে তুলতে পারে।