বিকল্প বিনিয়োগ তহবিল (Alternative Investment Fund – AIF) বাজারে বিনিয়োগকারীদের পরিসর আরও সুসংহত ও মানসম্মত করতে বড় পদক্ষেপের পথে পা বাড়াল ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI)। সংস্থাটি এক নয়া প্রস্তাবিত স্কিমের কথা ঘোষণা করেছে, যা শুধুমাত্র ‘অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টর’ বা স্বীকৃত বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সেবির বক্তব্য, এই ধরনের বিশেষায়িত এআইএফ স্কিমকে নিয়মিত এআইএফ-এর তুলনায় ‘হালকা’ বা সহজতর নিয়ন্ত্রক কাঠামোর আওতায় আনা হবে। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীরা বেশি স্বাধীনতা এবং নমনীয়তার সুযোগ পাবেন, আর ফান্ড ম্যানেজারদের জন্যও একাধিক বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি থাকবে।
কে হবেন ‘অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টর’?
‘অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টর’ বলতে এমন ব্যক্তি বা সংস্থাকে বোঝানো হয় যারা সেবি নির্ধারিত সম্পদ, আয় ও বিনিয়োগ অভিজ্ঞতার মানদণ্ড পূরণ করেন। উদাহরণস্বরূপ—
একক মালিকানা প্রতিষ্ঠান (Sole Proprietorship), হিন্দু অবিভক্ত পরিবার (HUF) ও ফ্যামিলি ট্রাস্ট— বছরে ন্যূনতম ২ কোটি টাকা আয়, অথবা ন্যূনতম ৭.৫ কোটি টাকা মোট সম্পদ, যার মধ্যে অন্তত ৩.৭৫ কোটি টাকা আর্থিক সম্পদ থাকতে হবে।
এই স্বীকৃতি প্রদান করে সেবি অনুমোদিত সংস্থা, যেমন স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিপোজিটরির সহযোগী প্রতিষ্ঠান—উদাহরণস্বরূপ CDSL Ventures Limited। প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীর সম্পদ, আর্থিক অবস্থা ও বিনিয়োগ অভিজ্ঞতা যাচাই করা হয়।
নতুন প্রস্তাবের মূল দিক:
বর্তমানে এআইএফ-এ বিনিয়োগের জন্য প্রতি বিনিয়োগকারীর ন্যূনতম ₹১ কোটি বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক। সেবির সাম্প্রতিক পরামর্শপত্রে প্রস্তাব করা হয়েছে, ধাপে ধাপে এই ‘ন্যূনতম বিনিয়োগের অঙ্ক’ পদ্ধতি তুলে দিয়ে কেবলমাত্র ‘অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টর’ মর্যাদাকে বিনিয়োগকারীর যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে ধরা হবে।
এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে কার্যকর হবে। প্রথমে দুইটি পদ্ধতি একসঙ্গে চলবে— অর্থাৎ, কিছু স্কিমে পুরনো নিয়ম কার্যকর থাকবে, আর কিছু বিশেষ স্কিম শুধুমাত্র স্বীকৃত বিনিয়োগকারীদের জন্য খোলা হবে। এই প্রস্তাবের উপর মতামত পাঠানোর শেষ তারিখ ২৯ আগস্ট।
‘অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টর’-মুখী স্কিমের বিশেষ সুবিধা:
সেবি জানিয়েছে, শুধুমাত্র অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টরদের জন্য তৈরি স্কিমগুলিকে বেশ কয়েকটি নিয়ন্ত্রক ছাড় দেওয়া হতে পারে—
1. প্যারিপাসু অধিকার থেকে অব্যাহতি: সাধারণত, এআইএফ বিনিয়োগকারীদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হয়। তবে এই ক্ষেত্রে, বিনিয়োগকারীরা লিখিত সম্মতি দিলে সমান অধিকার বজায় রাখার বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
2. স্কিমের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ: প্রচলিত নিয়মে নির্দিষ্ট মেয়াদের পর ফান্ড বন্ধ হয়, কিন্তু এই বিশেষ স্কিমে বিনিয়োগকারীদের দুই-তৃতীয়াংশ (মূল্য অনুযায়ী) সম্মত হলে মেয়াদ সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।
3. ‘সার্টিফিকেশন ওয়েভার’: সাধারণ এআইএফ-এ বিনিয়োগ দলের সদস্যদের নির্দিষ্ট NISM সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু স্বীকৃত বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে এই শর্ত শিথিল হতে পারে, কারণ এরা নিজেরাই যথেষ্ট অভিজ্ঞ এবং নিজস্ব যাচাই (due diligence) করতে সক্ষম।
4. বিনিয়োগকারীর সীমা থাকবে না: বর্তমানে একটি স্কিমে সর্বাধিক ১,০০০ বিনিয়োগকারীর সীমা রয়েছে। কিন্তু অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টরদের জন্য তৈরি স্কিমে এই সীমাবদ্ধতা থাকবে না।
5. ট্রাস্টির ভূমিকা ম্যানেজারের হাতে: সাধারণত এআইএফ-এর জন্য ট্রাস্টি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে। তবে এই ক্ষেত্রে, সেই সমস্ত দায়িত্ব সরাসরি ফান্ড ম্যানেজার পালন করবেন।
বাজারের প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা:
বর্তমানে অ্যাক্রেডিটেড ইনভেস্টরের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে সেবি আশা করছে, সাম্প্রতিক নিয়ম সংশোধন ও প্রক্রিয়ার সরলীকরণের ফলে এই সংখ্যা দ্রুত বাড়বে। এই লক্ষ্যে একাধিক পদক্ষেপ বিবেচনাধীন—
অ্যাক্রেডিটেশন সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি
প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেবা মানোন্নয়ন
স্বীকৃতি প্রক্রিয়াকে আরও সহজ ও সময়সাশ্রয়ী করা
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপের ফলে উচ্চ নেট মূল্যের বিনিয়োগকারী (HNI) এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা আরও বেশি বিকল্প পাবে। একই সঙ্গে, ফান্ড ম্যানেজাররা বিনিয়োগ কৌশলে বেশি স্বাধীনতা পাবেন, কারণ স্বীকৃত বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সুরক্ষার অতিরিক্ত নিয়ম মানার প্রয়োজন হবে না।
তবে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণীও রয়েছে— নিয়ন্ত্রক ছাড়ের কারণে স্কিমের ঝুঁকি কিছুটা বেড়ে যেতে পারে, যা শুধুমাত্র অভিজ্ঞ ও সক্ষম বিনিয়োগকারীদের জন্যই উপযুক্ত। ফলে সেবির এই পদক্ষেপ মূলত একটি ‘নিচ মার্কেট’ বা বিশেষ গোষ্ঠীর বিনিয়োগকারীদের জন্য তৈরি।
সেবির এই প্রস্তাব কার্যকর হলে ভারতের বিকল্প বিনিয়োগ তহবিল খাতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। এতে বাজারে পুঁজি প্রবাহ বাড়বে, বিনিয়োগ কৌশলের বৈচিত্র্য বাড়বে এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ মানদণ্ডের সঙ্গে ভারতের সামঞ্জস্য আরও মজবুত হবে। তবে শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব কতটা বাস্তবায়িত হবে এবং এর প্রভাব কেমন হবে, তা নির্ভর করবে বিনিয়োগকারী ও বাজারের প্রতিক্রিয়ার উপর।