৭ কৃষি পণ্যের ডেরিভেটিভ ট্রেডিংয়ের স্থগিতাদেশ বাড়াল সেবি

ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (Sebi) সোমবার ঘোষণা করেছে যে, সাতটি কৃষি পণ্যের ডেরিভেটিভ ট্রেডিংয়ের উপর স্থগিতাদেশ আরও এক বছরের…

Sebi , agricultural commodity, wheat,moong,

ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (Sebi) সোমবার ঘোষণা করেছে যে, সাতটি কৃষি পণ্যের ডেরিভেটিভ ট্রেডিংয়ের উপর স্থগিতাদেশ আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে, অর্থাৎ মার্চ ২০২৬ পর্যন্ত। এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হল ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। স্থগিত কৃষি পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে গম, মুগ ডাল, ধান (নন-বাসমতি), ছোলা, ক্রুড পাম অয়েল, সরিষার বীজ ও এর ডেরিভেটিভ এবং সয়াবিন ও এর ডেরিভেটিভ।

Also Read |  কৃষকদের সমান সুবিধার আশায় প্রান্তিক চা চাষিরা

সেবি প্রথমবার এই নির্দেশিকা জারি করেছিল ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে। প্রাথমিকভাবে এই স্থগিতাদেশ ২০ ডিসেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে এটি এক বছরের জন্য বাড়িয়ে ২০ ডিসেম্বর, ২০২৩ পর্যন্ত করা হয়। এরপর আবারও এটি ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সর্বশেষে, গত জানুয়ারিতে এই স্থগিতাদেশ ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল এবং তারপর দুই মাসের জন্য মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত। এখন সেবি এই স্থগিতাদেশ আরও এক বছর বাড়িয়ে মার্চ ২০২৬ পর্যন্ত করেছে।

কেন এই স্থগিতাদেশ?
সেবি এই সাতটি কৃষি পণ্যের ফিউচার এবং অপশন ট্রেডিং স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে অতিরিক্ত জল্পনা-কল্পনা রোধ করার জন্য। ২০২১ সালে যখন এই নিষেধাজ্ঞা প্রথম জারি করা হয়, তখন ভারতে খাদ্য পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গিয়েছিল। পাইকারি মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের নভেম্বরে ১৪.২৩ শতাংশে পৌঁছে যায়, যা অক্টোবরে ছিল ১২.৫ শতাংশ। এই সময়ে গম, ছোলা, মুগ ডাল এবং ভোজ্য তেলের দামে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গিয়েছিল। সরকারের উপর খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিরোধী দলগুলোর চাপ বাড়ছিল, বিশেষ করে গোয়া, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের আগে।

এই স্থগিতাদেশের ফলে এই পণ্যগুলোর নতুন ফিউচার ট্রেডিং বন্ধ থাকবে, তবে বিদ্যমান পজিশনগুলো স্কোয়ার অফ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হল, ব্যবসায়ীরা তাদের বর্তমান চুক্তিগুলো শেষ করতে পারবেন, কিন্তু নতুন কোনো চুক্তি শুরু করতে পারবেন না।

বাঙালি কৃষক ও ব্যবসায়ীদের উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে এই স্থগিতাদেশের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হতে পারে, কারণ রাজ্যের কৃষকরা ধান, সরিষা এবং অন্যান্য কৃষি পণ্যের উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিউচার ট্রেডিং কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, যা তাদের ভবিষ্যতের দাম সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং দামের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে কৃষকরা তাদের পণ্যের ভবিষ্যৎ দাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবেন না, যা তাদের বিক্রয় পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলতে পারে।

Advertisements

একজন মেদিনীপুরের কৃষক বলেন, “আমরা ধান ও সরিষার উপর নির্ভরশীল। ফিউচার ট্রেডিং না থাকলে আমরা বাজারের দাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাই না। এটি আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে।” ব্যবসায়ীদের জন্যও এটি একটি চ্যালেঞ্জ। সরিষার তেল এবং অন্যান্য ভোজ্য তেলের আমদানিকারকরা ফিউচার মার্কেটে হেজিংয়ের মাধ্যমে দামের ঝুঁকি থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতেন। এই স্থগিতাদেশের ফলে তারা আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারেন।

সমালোচনা ও বিকল্প দৃষ্টিকোণ
এই স্থগিতাদেশ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ভারতের ভোজ্য তেল শিল্প এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, ফিউচার ট্রেডিং না থাকায় আমদানিকারকরা দামের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারছেন না এবং ভবিষ্যৎ দাম সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেন না। এছাড়া, এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উদাহরণস্বরূপ, গমের দাম রেকর্ড উৎপাদন সত্ত্বেও কুইন্টাল প্রতি ৩,২০০ টাকায় পৌঁছেছে। ভোক্তারাও ডাল এবং ভোজ্য তেলের জন্য বেশি দাম দিচ্ছেন।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে কৃষি বাজারের ক্ষতি করতে পারে। ফিউচার ট্রেডিং কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জন্য দাম আবিষ্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এটি না থাকলে বাজারে স্বচ্ছতা কমে যায় এবং কৃষকরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, “সরকারের উচিত ছিল জনসাধারণের বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করা এবং আমদানি শুল্ক কমানো। ফিউচার ট্রেডিং বন্ধ করা সমস্যার সমাধান নয়।”

সেবি এই স্থগিতাদেশের কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও, এটি কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মার্চ ২০২৬ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বাড়ানোর ফলে কৃষি বাজারে আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক ও ব্যবসায়ীদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জিং সময়। তবে, সরকার যদি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যেমন আমদানি শুল্ক কমানো বা কৃষকদের জন্য সরাসরি সহায়তা প্রদান, তবে এই প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব। আগামী দিনে সেবি এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কি না, সেদিকে নজর থাকবে সবার।