শিক্ষার বেলাগাম খরচ সামলাতে অভিভাবকদের কাঁধে ঋণের বোঝা বাড়ছে

ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিবছর স্কুল ভর্তির (School Admissions) প্রক্রিয়া পিতামাতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৫ সালে, স্কুলের ফি এবং সম্পর্কিত খরচের ক্রমবর্ধমান হার…

School Admissions 2025 Rising Costs Drive Surge in Personal Loans

ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিবছর স্কুল ভর্তির (School Admissions) প্রক্রিয়া পিতামাতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৫ সালে, স্কুলের ফি এবং সম্পর্কিত খরচের ক্রমবর্ধমান হার পিতামাতাকে তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগত ঋণের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। শিক্ষার গুণগত মান এবং সন্তানের স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষা পিতামাতার মনে একদিকে যেমন আশা জাগাচ্ছে, তেমনি আর্থিক চাপ তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালে স্কুল ভর্তির খরচ বৃদ্ধির প্রভাব, পিতামাতার মানসিক চাপ এবং ব্যক্তিগত ঋণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করব।

ক্রমবর্ধমান স্কুল ফি এবং খরচ
ভারতের মেট্রো শহর যেমন দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু এবং কলকাতায় বেসরকারি স্কুলগুলোর ভর্তি ফি এবং বার্ষিক খরচ গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালে, কলকাতার শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তি ফি ৫০,০০০ থেকে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া, বার্ষিক ফি, টিউশন ফি, পরিবহন, ইউনিফর্ম, বই, এবং অতিরিক্ত কার্যক্রমের খরচ মিলিয়ে বছরে ৩ থেকে ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ হতে পারে। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য, যাদের মাসিক আয় ৫০,০০০ থেকে ১ লক্ষ টাকা, এই খরচ তাদের আর্থিক পরিকল্পনায় বড় চাপ সৃষ্টি করছে।

   

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে কলকাতার বেসরকারি স্কুলগুলোর ফি গড়ে ১২-১৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতার একটি নামকরা স্কুলে নার্সারি ভর্তির জন্য এককালীন ফি ১.৫ লক্ষ টাকা এবং বার্ষিক ফি ৪ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। এই খরচ মেটাতে অনেক পিতামাতা তাদের সঞ্চয় ভাঙছেন বা ব্যক্তিগত ঋণ নিচ্ছেন।

পিতামাতার মানসিক চাপ
সন্তানের শিক্ষা নিশ্চিত করা পিতামাতার জন্য একটি মানসিক এবং আর্থিক যাত্রা। কলকাতার একজন পিতা, অরুণ মজুমদার, এক্স প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “আমার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য একটি ভাল স্কুলে ভর্তি করা আমার স্বপ্ন। কিন্তু ফি এত বেশি যে আমাকে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। এটি আমার মানসিক চাপ বাড়িয়েছে, তবে আমি চাই আমার মেয়ে সেরা শিক্ষা পাক।” এই ধরনের আবেগপ্রবণ মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে, যা পিতামাতার মধ্যে আর্থিক চাপের গভীরতা প্রকাশ করে।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, স্কুল ভর্তির খরচ মেটানোর চাপ পিতামাতার মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করছে। কলকাতার মনোবিজ্ঞানী ডাঃ রিয়া সেন বলেন, “পিতামাতারা তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করেন, একটি ভাল স্কুলে ভর্তি না করতে পারলে তাদের সন্তান পিছিয়ে পড়বে। এই চিন্তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলছে।”

ব্যক্তিগত ঋণের প্রবণতা
ক্রমবর্ধমান শিক্ষার খরচ মেটাতে পিতামাতারা ব্যক্তিগত ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। ব্যাঙ্ক এবং নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি) থেকে শিক্ষা ঋণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ঋণের চাহিদা বেড়েছে। একটি রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৪-২৫ সালে ভারতের শিক্ষা ঋণের বাজার ১২% বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মধ্যে বেসরকারি স্কুল ভর্তির জন্য ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক, এসবিআই এবং বজাজ ফিনসার্ভের মতো প্রতিষ্ঠান ১০-১৪% সুদের হারে ৫ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ব্যক্তিগত ঋণ দিচ্ছে।

কলকাতার একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার জানিয়েছেন, “গত এক বছরে আমরা স্কুল ফি এবং ভর্তির জন্য ব্যক্তিগত ঋণের আবেদন ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। পিতামাতারা সাধারণত ২-৫ লক্ষ টাকার ঋণ নিচ্ছেন, যা ৩-৫ বছরের মেয়াদে পরিশোধ করা হয়।” তবে, এই ঋণের উচ্চ সুদের হার এবং মাসিক কিস্তি পিতামাতার আর্থিক চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

Advertisements

পিতামাতার আবেগ ও সন্তানের ভবিষ্যৎ
পিতামাতার জন্য সন্তানের শিক্ষা একটি আবেগপ্রবণ বিষয়। কলকাতার একজন গৃহিণী, মিতা দাস, বলেন, “আমার ছেলের ভবিষ্যৎ আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সঞ্চয় ভেঙে এবং ঋণ নিয়ে তাকে একটি ভাল স্কুলে ভর্তি করেছি। এটি আমাদের জন্য কঠিন, কিন্তু তার হাসি আমাদের সব চাপ ভুলিয়ে দেয়।” এই ধরনের আবেগ পিতামাতার মধ্যে সাধারণ, যারা তাদের সন্তানের জন্য সেরা শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে চান।

সামাজিক মাধ্যমে পিতামাতারা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। এক্স-এ একজন পিতা লিখেছেন, “স্কুল ফি এত বেশি যে আমরা আমাদের স্বপ্নের বাড়ির জন্য সঞ্চয় ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমার মেয়ে যখন বলে ‘বাবা, আমি ডাক্তার হব’, তখন মনে হয় এটি মূল্যবান।” এই আবেগপ্রবণ পোস্টগুলো প্রমাণ করে যে, পিতামাতারা সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।

সমাধানের পথ
আর্থিক চাপ কমাতে পিতামাতারা কিছু বিকল্প পদক্ষেপ নিতে পারেন। প্রথমত, সরকারি এবং সাশ্রয়ী বেসরকারি স্কুলগুলোর গুণগত মান পরীক্ষা করা যেতে পারে। কলকাতায় কিছু সরকারি স্কুল এবং মিশনারি স্কুল উচ্চমানের শিক্ষা প্রদান করে, যার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ঋণের পরিবর্তে ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার আগে সুদের হার এবং পরিশোধের মেয়াদ তুলনা করা উচিত। তৃতীয়ত, পিতামাতারা আর্থিক পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষার খরচের জন্য আগাম সঞ্চয় শুরু করতে পারেন।

সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এই সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার বেসরকারি স্কুলের ফি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি প্রণয়ন করতে পারে। এছাড়া, শিক্ষা ঋণে সুদের হার কমানো এবং স্কলারশিপ প্রোগ্রাম বাড়ানো পিতামাতার জন্য স্বস্তি আনতে পারে।

২০২৫ সালে স্কুল ভর্তির ক্রমবর্ধমান খরচ পিতামাতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা তাদের ব্যক্তিগত ঋণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা আর্থিক এবং মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে। তবে, তাদের সন্তানের হাসি এবং সাফল্যের জন্য এই ত্যাগ পিতামাতার কাছে মূল্যবান। কলকাতার পিতামাতারা তাদের সন্তানের জন্য সেরা শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং এই আবেগ তাদের চাপ মোকাবেলার শক্তি জোগাচ্ছে। সরকার, ব্যাঙ্ক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা এই চাপ কমাতে পারে, যাতে পিতামাতারা তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনে মনোযোগ দিতে পারেন। আপনার সন্তানের শিক্ষার জন্য কীভাবে পরিকল্পনা করছেন?