রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (RBI) সম্প্রতি টানা তৃতীয়বারের মতো রেপো রেট কমিয়ে ৫.৫ শতাংশে নামিয়েছে। লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষের ঋণ নেওয়ার খরচ কমানো এবং আর্থিক কার্যকলাপে গতি আনা। কিন্তু দেশের সর্ববৃহৎ গৃহঋণদাতা প্রতিষ্ঠান স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (SBI) উল্টোদিকে নতুন ঋণগ্রহীতাদের জন্য হোম লোনের সুদের হার বাড়িয়ে দিল ২৫ বেসিস পয়েন্ট।
এসবিআই জানিয়েছে, তাদের হোম লোনের সুদের হার এখন থেকে আগের ৭.৫০ শতাংশ–৮.৪৫ শতাংশ ব্যান্ডের বদলে ৭.৫০ শতাংশ–৮.৭০ শতাংশ হবে। অর্থাৎ ঋণের নিম্ন ব্যান্ডে পরিবর্তন না হলেও উচ্চ ব্যান্ডে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বা ০.২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে সেইসব গ্রাহকদের উপর যাদের ক্রেডিট স্কোর তুলনামূলকভাবে কম। কারণ ক্রেডিট স্কোর কম হলে ঋণগ্রহীতাদের উচ্চ ব্যান্ডে অর্থাৎ সর্বোচ্চ হারে সুদ দিতে হয়।
এসবিআইয়ের পাশাপাশি অন্য সরকারি ব্যাঙ্কগুলিও বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক সুদের হারে হোম লোন দিচ্ছে। যেমন, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া, ব্যাঙ্ক অব মহারাষ্ট্র এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া হোম লোন দিচ্ছে ৭.৩৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০.১০ শতাংশ পর্যন্ত, যা সম্পূর্ণভাবে ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট প্রোফাইলের উপর নির্ভরশীল। তবে বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা, এসবিআই-এর পথে হেঁটে অন্য ব্যাঙ্কগুলিও আগামী দিনে সুদের হার বাড়াতে পারে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বস্তি এনে দেওয়া। কারণ, রেপো রেট কমালে সরাসরি কমে যায় ঋণের সুদের হার, বিশেষ করে গৃহঋণ বা অটো লোনের মতো খাতে। এভাবে গ্রাহকের কিস্তির চাপ কমে এবং খরচ বাড়ে, যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সহায়ক।
কিন্তু এসবিআই-এর নতুন সিদ্ধান্ত সাধারণ গ্রাহকদের মনে দ্বিধা তৈরি করছে। রেপো রেট কমলেও দেশের সর্ববৃহৎ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান যদি সুদের হার বাড়ায়, তবে অন্য ব্যাঙ্কও একই পথে হাঁটতে পারে। এর ফলে গৃহঋণের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত স্বস্তি পাওয়া মুশকিল হবে।
এসবিআই-এর গবেষণা শাখার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নির্ধারিত বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির প্রায় ৬০ শতাংশ ঋণই External Benchmark Lending Rate (EBLR)-এর সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ এই ঋণের হার সরাসরি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেপো রেট প্লাস একটি নির্দিষ্ট ‘স্প্রেড’-এর উপর নির্ভর করে। ফলে রেপো রেট কমলে সাধারণত এই ধরনের ঋণের হারও কমে যায়।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। যদিও রেপো রেট কমেছে, তবুও এসেবিআই সুদের উচ্চ ব্যান্ড বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ যেসব নতুন ঋণগ্রহীতা তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তাদের জন্য ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।
এসবিআই ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছে যে, রেপো রেট কমায় ঋণগ্রহীতাদের কিস্তির চাপ কমলেও ব্যাঙ্কগুলির উপর মুনাফার চাপ বাড়ছে। কারণ, জমা (ডিপোজিট) এবং অন্যান্য খরচের ভারসাম্য রাখতে গিয়ে ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায়শই সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আরবিআই-এর উদ্যোগে ঋণের সুদ কমানোর পথ তৈরি হলেও, ব্যাঙ্কগুলি তাদের মুনাফা ও ব্যালান্স শিট সামলাতে গিয়ে অনেক সময় গ্রাহকদের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পুরোপুরি দিতে পারে না। এই কারণেই রেপো রেট কাটের পরও গ্রাহকরা প্রত্যাশিত স্বস্তি পান না।
নতুন সুদের হার কার্যকর হলে, ৩০ লাখ টাকার গৃহঋণে মাসিক কিস্তি বা ইএমআই কমার বদলে বাড়তে পারে প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত, যদি ঋণগ্রহীতার ক্রেডিট স্কোর কম হয়। দীর্ঘমেয়াদে এই বাড়তি কিস্তি ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক চাপে ফেলবে।
অন্যদিকে, যাদের ক্রেডিট স্কোর ভালো, তারা এখনও নিম্ন ব্যান্ডে ঋণ পেতে পারবেন। তবে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ার ফলে সামগ্রিকভাবে হোম লোনের ক্ষেত্রটি গ্রাহকদের জন্য জটিল হয়ে উঠছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, আগামী দিনে সুদের হার নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যদি আবারও রেপো রেট কমায়, তবে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে। কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি তাদের আর্থিক চাপ সামলাতে গিয়ে যদি বারবার সুদের হার বাড়ায়, তবে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
বিশেষজ্ঞরা গ্রাহকদের পরামর্শ দিচ্ছেন, হোম লোন নেওয়ার আগে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সুদের হার ও শর্ত ভালোভাবে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে। বিশেষত ক্রেডিট স্কোর ভালো রাখার দিকে নজর দেওয়া জরুরি, কারণ সেটি সরাসরি সুদের হারে প্রভাব ফেলে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেপো রেট কমানোর সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তির বার্তা হলেও, এসবিআই-এর মতো বড় ব্যাঙ্কগুলির সুদের হার বাড়ানো বাজারে মিশ্র বার্তা দিচ্ছে। ফলে ঋণগ্রহীতাদের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে উঠছে। একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক খরচ কমিয়ে অর্থনীতি সচল রাখতে চাইছে, অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি নিজেদের মুনাফার ভারসাম্য রক্ষায় সুদের হার বাড়াচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি মধ্যবিত্ত ও নবীন ঋণগ্রহীতাদের উপর।