এয়ারবাস ডিফেন্স থেকে ১৬০ কোটি টাকার বরাত পেল সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং

বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং (Sansera Engineering) লিমিটেড ৪ জুন, ২০২৫-এ এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেসের কাছ থেকে ১৬০ কোটি টাকার (প্রায় ১৮.৮ মিলিয়ন মার্কিন…

Sansera Engineering Airbus Defence

বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং (Sansera Engineering) লিমিটেড ৪ জুন, ২০২৫-এ এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেসের কাছ থেকে ১৬০ কোটি টাকার (প্রায় ১৮.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি পেয়েছে। এই চুক্তির আওতায় সানসেরা লাইট এবং মিডিয়াম ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট প্রোগ্রামের জন্য এয়ারবর্ন ইনটেনসিভ কেয়ার ট্রান্সপোর্ট মডিউল (আইসিটিএম) উৎপাদন, সরবরাহ এবং সাপোর্ট করবে। এটি ভারতীয় ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, কারণ এটি প্রথমবারের মতো এয়ারবাস একটি ভারতীয় সরবরাহকারীকে আইসিটিএম কিট তৈরির জন্য নির্বাচিত করেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই চুক্তির বিস্তারিত, এর তাৎপর্য এবং ভারতের মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা শিল্পে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

চুক্তির বিস্তারিত
সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং এই চুক্তির অধীনে এয়ারবাসের লাইট এবং মিডিয়াম ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটের জন্য এয়ারবর্ন ইনটেনসিভ কেয়ার ট্রান্সপোর্ট মডিউল (আইসিটিএম) তৈরি, সরবরাহ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আইসিটিএম হল একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা উচ্ছেদ ব্যবস্থা, যা জরুরি অবস্থায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের, বিশেষ করে নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন এমন রোগীদের বিমানে পরিবহনের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই মডিউলটি প্রতিরক্ষা এবং মানবিক মিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এটি উড়ানের সময় হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের (আইসিইউ) সমতুল্য চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে।

   

সানসেরা তার বেঙ্গালুরুর অত্যাধুনিক সুবিধায় এই মডিউলগুলোর প্রিসিশন মেশিনিং এবং স্ট্রাকচারাল অ্যাসেম্বলি পরিচালনা করবে। চুক্তিটি একটি দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বের অংশ, যেখানে প্রথম চালান ২০২৬ সালের শেষের দিকে সরবরাহ করা হবে। এরপর এয়ারবাসের ডেলিভারি শিডিউল অনুযায়ী পরবর্তী চালানগুলো সম্পন্ন হবে। এই চুক্তি সানসেরার বিশ্বব্যাপী মহাকাশ সরবরাহ চেইনের মধ্যে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।

সানসেরার পটভূমি
সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং একটি প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, যিনি অটোমোটিভ এবং নন-অটোমোটিভ সেক্টরে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরি করে। বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত এই কোম্পানিটি ২০১০ সাল থেকে মহাকাশ শিল্পে প্রবেশ করেছে এবং বর্তমানে এয়ারবাস এবং বোয়িং-এর মতো বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর জন্য উচ্চ-নির্ভুলতার উপাদান সরবরাহ করে। সানসেরার এয়ারোস্পেস ডিভিশন AS9100 (Rev. D) সার্টিফাইড, যা মহাকাশ শিল্পের জন্য উচ্চমানের উৎপাদন মান নিশ্চিত করে। কোম্পানিটি A320, A330, A350, A380 এবং বোয়িংয়ের 737, 747, 767, 777 এবং 787 মডেলের জন্য উপাদান সরবরাহ করছে।

সানসেরার চেয়ারম্যান এবং ম্যানেজিং ডিরেক্টর এস শেখর ভাসান বলেছেন, “এয়ারবাসের মতো বিশ্বব্যাপী শীর্ষস্থানীয় মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা কোম্পানির ভারতীয় সরবরাহ চেইন অংশীদার হিসেবে নির্বাচিত হওয়া আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এই কৌশলগত অংশীদারিত্ব আমাদের প্রিসিশন ম্যানুফ্যাকচারিং-এর শীর্ষস্থানীয় অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “এই চুক্তি প্রধানমন্ত্রীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে সমর্থন করে এবং ভারতের প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”

ভারতের মহাকাশ শিল্পে তাৎপর্য
এই চুক্তি ভারতের মহাকাশ এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। প্রথমবারের মতো এয়ারবাস একটি ভারতীয় কোম্পানিকে আইসিটিএম কিট তৈরির জন্য নির্বাচিত করেছে, যা ভারতের ক্রমবর্ধমান ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষমতার প্রমাণ। এই চুক্তি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’ উদ্যোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা দেশের প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ সেক্টরে স্বনির্ভরতা বাড়ানোর লক্ষ্য রাখে। এটি ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনে প্রবেশের পথ প্রশস্ত করবে।

সানসেরার এই সাফল্য ভারতের মধ্যে এবং বাইরে অন্যান্য কোম্পানিগুলোর জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করবে। এটি দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো (এমএসএমই) এবং স্থানীয় সরবরাহকারীদের জন্যও সুযোগ সৃষ্টি করবে, কারণ সানসেরা এই প্রকল্পের জন্য স্থানীয় সরবরাহকারীদের সঙ্গে কাজ করবে। এই চুক্তি ভারতের মহাকাশ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করবে এবং উচ্চ-নির্ভুলতার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

Advertisements

শেয়ার বাজারে প্রভাব
এই চুক্তির ঘোষণার পর সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শেয়ার দামে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ৪ জুন, ২০২৫-এ ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে (এনএসই) কোম্পানির শেয়ার ১.২১% কমে ১,৩৪৯.১০ টাকায় বন্ধ হয়েছে, যেখানে বেঞ্চমার্ক নিফটি ০.৩২% বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, গত ১২ মাসে সানসেরার শেয়ার ৩৭.৫২% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কোম্পানির শক্তিশালী বৃদ্ধির সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। বছরের শুরু থেকে শেয়ারের দাম ৯.৪৫% কমলেও, ব্লুমবার্গের তথ্য অনুসারে, ১৩ জন বিশ্লেষকের মধ্যে ১১ জন কোম্পানির শেয়ারে ‘কিনুন’ রেটিং দিয়েছেন, এবং দুজন ‘ধরে রাখুন’ পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্লেষকদের গড় ১২ মাসের দামের লক্ষ্যমাত্রা ১৪.২% বৃদ্ধির সম্ভাবনা নির্দেশ করে।

সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষ করে এক্স-এ, এই চুক্তি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “সানসেরার ১৬০ কোটি টাকার এয়ারবাস চুক্তি মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা সেক্টরে এর অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি শেয়ার পর্যবেক্ষণে রাখার মতো।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই চুক্তি সানসেরার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি কোম্পানির বিশ্বব্যাপী মহাকাশ সরবরাহ চেইনে অবস্থানকে শক্তিশালী করবে এবং ভারতের প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ শিল্পে নতুন সুযোগ তৈরি করবে। এই চুক্তি ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উ顯示িগুলোর জন্যও সম্ভাবনা উন্মোচন করবে, কারণ সানসেরা তার স্থানীয় সরবরাহকারীদের সঙ্গে কাজ করবে। এছাড়া, এটি ভারতের মহাকাশ শিল্পের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট, যা দেশকে বিশ্বব্যাপী ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে।
সানসেরার এই সাফল্য ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এটি দেশের প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ সেক্টরে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে সানসেরা এয়ারবাসের সঙ্গে আরও বড় প্রকল্পে অংশ নিতে পারে, যা ভারতের মহাকাশ শিল্পের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।

সানসেরা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেসের সঙ্গে ১৬০ কোটি টাকার চুক্তি ভারতের মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা শিল্পে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই চুক্তি শুধু সানসেরার জন্যই নয়, বরং ভারতের সমগ্র ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে শক্তিশালী করবে এবং ভারতকে বিশ্বব্যাপী মহাকাশ সরবরাহ চেইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। সানসেরার এই সাফল্য ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে এবং দেশের প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ শিল্পে আত্মনির্ভরতার পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।