ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত (Mohan Bhagwat)। ২০০৯ সাল থেকে সংগঠনের শীর্ষপদে থাকা ভাগবত বলেন, “ভারতের মতো দেশের জন্য ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়া বিশেষ কিছু নয়।” তাঁর এই মন্তব্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সরকারের সেই প্রচারমূলক বয়ানকে, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে জাতীয় গৌরবের বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারতের জিডিপি পৌঁছে যায় প্রায় ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। এই সাফল্যকে ক্ষমতাসীন শাসকদল ভারতের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মাইলফলক হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু মোহন ভাগবতের বক্তব্য যেন সেই আনন্দের আবহে ঠাণ্ডা জলের ছিটে ফেলেছে। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক মাইলফলককে সবসময় বৈশ্বিক মানদণ্ডে বিচার করা উচিত, এবং ভারতের সম্ভাবনা এত বড় যে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারকে চূড়ান্ত সাফল্য হিসেবে ধরা চলে না।
ঐতিহাসিক তুলনা
ভাগবতের এই বক্তব্যের তাৎপর্য বোঝা যায় যখন ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তী অর্থনৈতিক ইতিহাসে চোখ দেওয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ভারতের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির হার গড়ে ছিল মাত্র ৩.৫%—যাকে তৎকালীন অর্থনীতিবিদরা “হিন্দু রেট অফ গ্রোথ” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই তুলনায় গত দুই দশকে ভারতের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বেড়েছে, বিশেষত ২০০০ সালের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিস্তার এবং সেবা খাতের সম্প্রসারণ অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করেছে।
৩ ট্রিলিয়ন বনাম ১০ ট্রিলিয়নের লক্ষ্য
ভাগবতের মন্তব্যে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে—৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছনো কি যথেষ্ট, নাকি ভারতের লক্ষ্য হওয়া উচিত ১০ ট্রিলিয়ন ডলার বা তারও বেশি? অর্থনীতিবিদদের একাংশ বলছেন, ভারতের জনসংখ্যা, শ্রমশক্তি ও প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় এই অর্জন মাঝারি মানের, যেখানে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থাকা উচিত। অন্যদিকে, সরকারের সমর্থকেরা মনে করেন, গত দুই দশকে ভারতের অর্থনৈতিক যাত্রা—একটি ঔপনিবেশিক শোষণের শিকার দেশ থেকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে উত্তরণ—নিজেই এক অসাধারণ সাফল্যের গল্প।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
ভাগবতের মন্তব্যের পর থেকেই X (পূর্বতন টুইটার)-এ শুরু হয়েছে তর্ক-বিতর্ক। একদল নেটিজেন তাঁর বক্তব্যকে বাস্তবসম্মত ও প্রয়োজনীয় সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন, যাতে ভারত আত্মতুষ্টিতে ভুগে না পড়ে। অন্যদিকে অনেকে মনে করছেন, এই ধরনের মন্তব্য সরকারের সাফল্যকে খাটো করার সমান এবং এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়।
একই দিনে সাংস্কৃতিক আবহ
উল্লেখযোগ্যভাবে, ভাগবতের এই মন্তব্য এসেছে রক্ষাবন্ধন উৎসবের দিনেই। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্তা সেদিন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেন। যদিও রক্ষাবন্ধন ও ভাগবতের অর্থনৈতিক মন্তব্যের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই, তবে এই দুই ঘটনাই দেখিয়েছে—ভারতীয় সমাজে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার সমান্তরাল প্রবাহ কিভাবে একসঙ্গে চলতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদদের মতে, ভাগবতের বক্তব্যে এক ধরনের বাস্তবতা রয়েছে। ভারতের বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে আয়-বৈষম্য, কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এবং কৃষি খাতের ধীরগতি এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। কেবল জিডিপি বৃদ্ধির হার নয়, বরং উন্নয়নের মান ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করাই আগামী দিনের মূল কাজ হওয়া উচিত।
রাজনৈতিক তাৎপর্য
ভাগবতের বক্তব্য রাজনৈতিক মহলেও আলোড়ন তুলেছে। যদিও তিনি সরাসরি কোনো দলের সমালোচনা করেননি, তবুও বিরোধীরা এই মন্তব্যকে বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক নীতির প্রতি এক পরোক্ষ আস্থা-হীনতা হিসেবে তুলে ধরছে। অপরদিকে, ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্ররা বলছেন, এই মন্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এবং ভাগবতের উদ্দেশ্য কেবল ভারতের সামনে আরও বড় লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
মোহন ভাগবতের মন্তব্য ভারতের অর্থনৈতিক যাত্রা নিয়ে নতুন করে আলোচনার দ্বার খুলেছে। প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি বর্তমান অর্জন উদযাপন করব, নাকি আরও উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেব? স্বাধীনতার পর ধীরগতির অর্থনীতি থেকে আজকের অবস্থানে পৌঁছনো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে ভাগবতের মতে, এটাই শেষ নয়, বরং আরও অনেক দূর যাওয়ার পথ বাকি।
এই বিতর্ক প্রমাণ করছে, ভারতের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা শুধু সংখ্যার খেলা নয়—এটি জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মসমালোচনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন।