ভারতের ব্যাংকিং পরিষেবায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে মাইক্রো এটিএম-এর (Micro ATM) মাধ্যমে। শহরের বাইরে বসবাসকারী বহু মানুষ বহু বছর ধরে ব্যাংক পরিষেবা পেতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে এই ছবিটা বদলাচ্ছে। মাইক্রো এটিএমের প্রসার সেই পরিবর্তনেরই প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে। এই ছোট যন্ত্রগুলি এখন গ্রামের দোকানগুলিকে পরিণত করছে ছোট ব্যাংকিং কেন্দ্র হিসেবে।
ব্যাংক পরিষেবার অভিগম্যতার অভাব
যদিও ডিজিটাল ভারত গঠনের উদ্যোগে সরকারি প্রচেষ্টা জারি রয়েছে, তথাপি এখনও দেশের বহু গ্রামীণ ও আধা-শহরাঞ্চলের মানুষ মৌলিক ব্যাংক পরিষেবাগুলির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে ব্যাংকের শাখা বা এটিএমের মতো পরিকাঠামো অনেক জায়গাতেই নেই।
ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ বাস করেন গ্রামীণ অঞ্চলে, অথচ সেখানে দেশের মাত্র ২০ শতাংশ এটিএম রয়েছে। এই বৈষম্য দেখায় কী ভয়াবহ ভাবে গ্রামীণ ভারত ব্যাংকিং পরিষেবা থেকে বিচ্ছিন্ন। এই ব্যবধান ঘোচাতে মাইক্রো এটিএম এখন এক কার্যকর সমাধান হয়ে উঠেছে।
মাইক্রো এটিএম কীভাবে কাজ করে?
মাইক্রো এটিএম মূলত একটি হ্যান্ডহেল্ড পস (POS) ডিভাইস, যা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে লেনদেন করার সুযোগ দেয়। এটি সাধারণ এটিএমের মতো কাজ করে, কিন্তু আকারে ছোট এবং বহনযোগ্য। এক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের প্রতিনিধির মতো কাজ করেন।
প্রথমে গ্রাহক তাঁর ডেবিট কার্ডটি মেশিনে প্রবেশ করান এবং পিন নম্বর দেন। প্রক্রিয়া যাচাই হলে তিনি কত টাকা তুলতে চান তা জানান, এবং সেই টাকা ব্যবসায়ী হাতে হাতে দিয়ে দেন। এই প্রক্রিয়াটি সুরক্ষিত, দ্রুত ও সুবিধাজনক।
খরচ ছাড়াই সহজ ব্যাংকিং
মাইক্রো এটিএম ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের কোনও অতিরিক্ত খরচ হয় না। এই সুবিধা এক বিশেষ আশীর্বাদ গ্রামীণ মানুষের জন্য, যাঁদের অনেক সময় ব্যাংকে যেতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হয়। মাইক্রো এটিএমের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স চেক করতে পারেন এবং টাকা তুলতে পারেন স্থানীয় দোকান থেকেই।
সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান মাইক্রো এটিএম
যেখানে সাধারণ এটিএমের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে মাইক্রো এটিএমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত হারে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যেখানে দেশে প্রায় ২.১৯ লক্ষ এটিএম ছিল, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২.১৫ লক্ষে। এর মধ্যে অফ-সাইট এটিএমের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমেছে।
অন্যদিকে, মাইক্রো এটিএমের সংখ্যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিল ১.২৪ মিলিয়ন, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেড়ে হয়েছে ১.৪৬ মিলিয়ন — প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি। এই সংখ্যা প্রমাণ করে যে মাইক্রো এটিএম মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাংক পরিষেবা পৌঁছে দিতে কতটা কার্যকর।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নতুন দিগন্ত
মাইক্রো এটিএম শুধু ব্যাংক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়াই নয়, গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ‘বিজনেস করেসপন্ডেন্ট’ হিসাবে কাজ করে প্রতিটি লেনদেনের উপর কমিশন পান। এর ফলে তাঁদের আয়ও বাড়ছে।
বিশেষত গ্রামীণ নারীদের জন্য এই পরিষেবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নারী ব্যাংকে যেতে পারেন না পারিবারিক বা ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে। স্থানীয় দোকানেই যদি ব্যাংক পরিষেবা মেলে, তাহলে তাঁদের আর্থিক স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণ অনেক বাড়বে।
ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ
মাইক্রো এটিএম শুধু একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, এটি এক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। ব্যাংকগুলির জন্যও এটি লাভজনক, কারণ এর মাধ্যমে তারা কম খরচে গ্রামীণ অঞ্চলে পরিষেবা পৌঁছে দিতে পারছে।
এই ছোট ডিভাইসগুলি যে শুধু অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াচ্ছে তা নয়, একইসাথে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা বাড়াচ্ছে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ভারতের আর্থিক ব্যবস্থায় মাইক্রো এটিএম এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রতীক। এই প্রযুক্তি শুধু ব্যাংক পরিষেবা সহজলভ্য করছে না, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করে তুলছে। অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির এই প্রয়াস আগামী দিনে ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে — এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।