রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ৪৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা (AGM)-তে এ বছর এক নতুন ইতিহাস রচনা হল। চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির উপস্থিতিতে আকাশ আম্বানি মঞ্চে উঠে ঘোষণা করলেন কয়েকটি যুগান্তকারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-ভিত্তিক প্রযুক্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দুটি হল জিওপিসি (JioPC) ও জিওফ্রেমস (JioFrames)।
রিলায়েন্স সবসময় ভারতীয়দের হাতে সহজলভ্য প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এবার এআইকে সাধারণ মানুষের জীবনে নিয়ে আসার জন্য কোম্পানি যে পদক্ষেপ নিল, তা ভারতের ডিজিটাল ভবিষ্যৎকে এক নতুন দিশা দেখাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আকাশ আম্বানি AGM-এ জানালেন, নতুন প্রোডাক্ট জিওপিসি সাধারণ একটি টিভি কিংবা যেকোনো স্ক্রিনকে রূপান্তর করবে একটি পূর্ণাঙ্গ এআই-সক্ষম কম্পিউটারে। এর মাধ্যমে ব্যয়বহুল হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হবে না। সাধারণ পরিবারের মধ্যেই উন্নতমানের কম্পিউটিং পৌঁছে যাবে।
জিওপিসি যুক্ত হবে JioAI ক্লাউড-এর সঙ্গে, যার ফলে ব্যবহারকারীরা উন্নতমানের অ্যাপ্লিকেশন চালাতে পারবেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নানা টুল ব্যবহার করতে পারবেন, আর পাবেন নিরবিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা। বিশেষত শিক্ষার্থী, পেশাজীবী ও ছোট ব্যবসার জন্য এটি হবে অত্যন্ত কার্যকর সমাধান। ভারতীয়দের জন্য এটি ডিজিটাল বিভাজন দূর করার এক বড় পদক্ষেপ।
জিওপিসির পাশাপাশি আকাশ আম্বানি ঘোষণা করলেন জিওফ্রেমস। এটি একটি এআই-চালিত স্মার্ট ওয়্যারেবল ইকোসিস্টেম। তিনি বলেন, “জিওফ্রেমস তৈরি হয়েছে ভারতের জন্য। একাধিক ভারতীয় ভাষায় সমর্থিত আমাদের মাল্টিলিঙ্গুয়াল এআই ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট-কে শুধু বললেই কাজ হবে। এটি একেবারে হ্যান্ডস-ফ্রি এআই কম্প্যানিয়ন।”
জিওফ্রেমস ব্যবহার করে ব্যবহারকারীরা ছবি তুলতে, ভিডিও রেকর্ড করতে বা সরাসরি লাইভ যেতে পারবেন। সব স্মৃতি নিরাপদে সংরক্ষিত হবে JioAI ক্লাউডে। এর সহজ-ব্যবহারযোগ্য নকশা ও উন্নত এআই ফিচার মিলিয়ে জিওফ্রেমস বদলে দিতে পারে ভারতীয়দের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।
এবার বিনোদনের জগতে জিও আনল আরও এক চমক – ভয়েস প্রিন্ট (Voice Print)। এর মাধ্যমে দর্শকরা নিজেদের পছন্দের ভারতীয় ভাষায় উপভোগ করতে পারবেন সিনেমা ও খেলার আসর, অথচ হারাবেন না মূল তারকাদের আসল কণ্ঠস্বরের স্বাদ।
এটি সম্ভব হচ্ছে উন্নত এআই ভয়েস ক্লোনিং ও লিপ-সিঙ্ক প্রযুক্তির মাধ্যমে। ফলে কোনো বলিউড তারকা বা ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার যেন সত্যিই দর্শকের মাতৃভাষাতেই কথা বলছেন – এমন অভিজ্ঞতা হবে। আকাশ আম্বানি বলেন, “এখন থেকে সিনেমা হোক বা ক্রিকেট ম্যাচ, আপনার ভাষাতেই আপনার প্রিয় তারকার কণ্ঠ শুনতে পাবেন, নিখুঁত লিপ-সিঙ্ক সহ।”
বিনোদনের কনটেন্ট খোঁজার ঝামেলাও এবার সহজ করবে জিও। আকাশ আম্বানি ঘোষণা করলেন রিয়া (RIYA) নামের নতুন এআই-ভিত্তিক ভয়েস সার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট।
প্রচুর সিনেমা, সিরিজ আর খেলার মধ্য থেকে কোনটা দেখবেন তা খুঁজে পাওয়া অনেক সময় জটিল হয়ে যায়। রিয়ার সাহায্যে দর্শকরা শুধু কণ্ঠে বলে দিলেই এআই সাজিয়ে দেবে উপযুক্ত কনটেন্ট – বছর, সিজন বা এপিসোড অনুযায়ী। আর দীর্ঘক্ষণ স্ক্রল করতে হবে না।
আকাশ আম্বানি AGM-এ পরিষ্কার জানালেন, জিও-র উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। “আমাদের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এখন বিশ্বজুড়েও কাজে লাগানো হবে। আগামী দিনে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধানে জিও অগ্রণী ভূমিকা নেবে।”
এই লক্ষ্য পূরণে থাকবে নানা কৌশলগত সহযোগিতা ও বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে শুধু ভারত নয়, বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারেও রিলায়েন্সের প্রভাব বাড়বে।
AGM-এ আকাশ আম্বানি জানালেন, জিও এয়ারফাইবার (Jio AirFiber) ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিক্সড ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। প্রতি মাসে এক মিলিয়নেরও বেশি নতুন পরিবারকে এই পরিষেবার আওতায় আনা হচ্ছে।
অন্যদিকে, মুকেশ আম্বানি আগেই ঘোষণা করেছিলেন যে, রিলায়েন্স ভবিষ্যতে “AI-First Company” হিসেবে কাজ করবে। তারই প্রতিফলন দেখা গেল এবারের AGM-এ। টেলিকম, খুচরো ব্যবসা, শক্তি ও বিনোদন—প্রতিটি ক্ষেত্রেই এআইকে কাজে লাগাতে চাইছে রিলায়েন্স।
মুকেশ আম্বানি এআই-কে আখ্যা দিলেন “আমাদের যুগের কামধেনু” হিসেবে। যেমন একসময় কামধেনু গরু ছিল অশেষ সম্পদের উৎস, তেমনি আজকের দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হতে পারে অগণিত সম্ভাবনার আধার।
জিওপিসি, জিওফ্রেমস, ভয়েস প্রিন্ট ও রিয়ার মতো উদ্ভাবনগুলো শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়; এগুলো ভারতের জন্য এক নতুন ভবিষ্যতের জানালা খুলে দিচ্ছে।
রিলায়েন্সের এবারের AGM প্রমাণ করে দিল, সংস্থাটি শুধু ব্যবসা নয়, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ভারতকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাধারণ মানুষের হাতে উন্নত এআই পৌঁছে দেওয়া, বিনোদনের অভিজ্ঞতা পাল্টে দেওয়া, বিশ্ববাজারে প্রভাব বিস্তার করা – সব ক্ষেত্রেই রিলায়েন্স এক অনন্য ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত।
ভারতের প্রযুক্তিগত যাত্রায় এটি নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায়।