ভারত দীর্ঘদিন ধরেই এক ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে, পরিবারের গঠন বদলাচ্ছে, আর সেই সাথে বাড়ছে চিকিৎসা ও দৈনন্দিন জীবনের খরচ। এমন পরিস্থিতিতে অবসরকালীন সুরক্ষার জন্য অর্থ সঞ্চয় আর কোনো বিকল্প নয়, এটি প্রয়োজনীয়।
দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ ভারতীয়ই অবসর পরিকল্পনাকে জীবনের শেষ ভাগের কাজ হিসেবে দেখে। অনেকেই এখনো পর্যন্ত ধারণা করে যে, পরিবারই ভবিষ্যতে তাদের সমস্ত দায়িত্ব নেবে বা শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী সঞ্চয় মাধ্যম যথেষ্ট হবে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের ছোট পরিবার, বাড়তি জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা খরচ আমাদের শেখাচ্ছে— অবসর পরিকল্পনা শীঘ্রই শুরু করা উচিত। ঠিক এই জায়গাতেই জাতীয় পেনশন সিস্টেম (NPS) এক গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হিসেবে উঠে এসেছে।
জাতীয় পেনশন সিস্টেম কী?
জাতীয় পেনশন সিস্টেম বা NPS হল একটি বাজার-সংযুক্ত, স্বেচ্ছাসেবী এবং দীর্ঘমেয়াদি অবসর কেন্দ্রিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা। এটি আপনার কর্মজীবনের সময়কালে ধারাবাহিক সঞ্চয়ের মাধ্যমে একটি বড় ফান্ড গড়ে তুলতে সহায়তা করে, যা অবসর জীবনে পেনশন আকারে আয় এনে দেয়। NPS নিয়ন্ত্রিত হয় পেনশন ফান্ড রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (PFRDA)-এর মাধ্যমে।
কেন আপনার অবসর পরিকল্পনায় NPS থাকা উচিত?
১. কম খরচে পেশাদার ম্যানেজমেন্ট:
এনপিএস ভারতের সবচেয়ে কম খরচের বিনিয়োগ বিকল্পগুলির মধ্যে একটি। এখানে অর্থ পরিচালনা করেন অভিজ্ঞ পেনশন ফান্ড ম্যানেজাররা, যাদের নিয়োগ করে পিএফআরডিএ। এর নিয়ন্ত্রিত গঠন নিশ্চিত করে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা এবং বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা।
২. চক্রবৃদ্ধি এবং বাজার-সংযুক্ত আয়ের শক্তি:
এনপিএসের মাধ্যমে আপনি শেয়ারবাজার, কর্পোরেট বন্ড, সরকারি সিকিউরিটি ও বিকল্প বিনিয়োগে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারেন। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ আয়ের সম্ভাবনা থাকে। আপনি নিজের ঝুঁকির ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে অ্যাকটিভ চয়েস অথবা অটো চয়েস (লাইফ সাইকেল) অপশন বেছে নিতে পারেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইকুইটির অংশ কমানো এবং ডেট বাড়ানোর সুবিধাও রয়েছে।
৩. স্থিতিশীলতা এবং নিয়ন্ত্রণ:
এনপিএসে আপনি বছরে চারবার পর্যন্ত আপনার অ্যাসেট অ্যালোকেশন পরিবর্তন করতে পারেন। এছাড়াও প্রতি বছর একবার ফান্ড ম্যানেজার পরিবর্তনের সুবিধা রয়েছে। আপনার পছন্দ অনুযায়ী অ্যাকটিভ ও অটো চয়েসের মধ্যে পরিবর্তনও করা সম্ভব। এর ফলে আপনার বিনিয়োগকে সময় ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন।
৪. অতুলনীয় কর সুবিধা:
পুরানো এবং নতুন দুই ধরনের ট্যাক্স রেজিমের অধীনে এনপিএসে বিনিয়োগ করলে বিশেষ কর সুবিধা পাওয়া যায়। এর ফলে এটি ভারতের সবচেয়ে ট্যাক্স-এফিশিয়েন্ট বিনিয়োগগুলির মধ্যে অন্যতম।
৫. নিয়মিত সঞ্চয়ের অভ্যাস:
মাসিক মাত্র ৫,০০০ টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে, ২৫–৩০ বছরে প্রায় ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ফান্ড গড়ে তোলা সম্ভব। এর সাথে ট্যাক্স সেভিংসের সুবিধা যোগ হলে একটি শক্তিশালী অবসর ফান্ড তৈরি হয়।
৬. জীবনভর পেনশন ও লাম্প সাম:
৬০ বছর বয়সে আপনি আপনার মোট সঞ্চয়ের ৬০% পর্যন্ত লাম্প সাম হিসেবে (বা ধাপে ধাপে) তুলতে পারেন, যা সম্পূর্ণ করমুক্ত। বাকি ৪০% দিয়ে বার্ষিক আয়ের (annuity) পরিকল্পনা নিতে হয়, যা আজীবন পেনশন হিসেবে কাজ করে। চাইলে, ৭৫ বছর পর্যন্ত লাম্প সাম তুলতে বিলম্ব করা এবং ধাপে ধাপে তুলতে Systematic Lumpsum Withdrawal Plan (SLWP) ব্যবহার করা যায়।
৭. পোর্টেবিলিটি ও ডিজিটাল সুবিধা:
চাকরি পরিবর্তন বা অন্য শহরে স্থানান্তরিত হলেও এনপিএস অ্যাকাউন্ট একই থাকে। নতুন করে কোনো অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন নেই। সব কিছুই অনলাইনে করা যায়— বিনিয়োগ, ফান্ডের অবস্থা দেখা এবং ব্যবস্থাপনা। এমনকি এনআরআই ও ওসিআই নাগরিকরাও এনপিএসে বিনিয়োগ করতে পারেন, যা তাদের জন্য ভারতের মধ্যে অবসরকালীন সঞ্চয়ের একটি আকর্ষণীয় পথ।
পরবর্তী পদক্ষেপ:
যদি আপনার NPS অ্যাকাউন্ট না থাকে, তাহলে আজই একটি অ্যাকাউন্ট খোলার কথা ভাবুন। এটি করতে পারেন অনুমোদিত Point of Presence (PoP) অথবা eNPS-এর মাধ্যমে।
যদি ইতিমধ্যে অ্যাকাউন্ট থেকে থাকে, তবে ফান্ডের ধরণ, অ্যাসেট মিশ্রণ এবং কনট্রিবিউশন স্ট্র্যাটেজি পর্যালোচনা করুন।
আপনার কোম্পানিকে কর্পোরেট এনপিএসের সুবিধা নেওয়ার জন্যও অনুপ্রাণিত করতে পারেন।
এক কথায়, NPS হল একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক হাতিয়ার। কম খরচ, নমনীয়তা, বাজার-সংযুক্ত বৃদ্ধির সুযোগ এবং কর সুবিধার কারণে এটি আপনার অবসর পরিকল্পনায় স্থায়ী জায়গা পাওয়ার যোগ্য। আর দেরি না করে আজই পরিকল্পনা শুরু করুন, ভবিষ্যতের আরাম নিশ্চিত করুন।