মুকেশ আম্বানির নেতৃত্বাধীন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ তাদের ৪৮তম বার্ষিক সাধারণ সভায় (AGM) স্পষ্ট বার্তা দিল যে, ভবিষ্যতের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। সভায় ঘোষণা করা হলো বিশ্বের দুই শীর্ষ প্রযুক্তি জায়ান্ট—গুগল ও মেটার সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব। এর মাধ্যমে এআই-ভিত্তিক সমাধান ও অবকাঠামো তৈরির মাধ্যমে শক্তি, টেলিকম, খুচরা বাজার, মিডিয়া থেকে শুরু করে উৎপাদন খাত—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে রিলায়েন্সের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা হবে।
সভায় মুকেশ আম্বানি ঘোষণা করেন মেটার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে (joint venture) একটি নতুন ভারত-কেন্দ্রিক এআই ভেঞ্চার চালু হচ্ছে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য হলো এমন এন্টারপ্রাইজ-গ্রেড সমাধান তৈরি করা যা ভারতের বহুমাত্রিক চাহিদা ও বিশাল পরিসরকে মাথায় রেখে গড়ে তোলা হবে।
আম্বানি বলেন, “আজ আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আমাদের দীর্ঘদিনের সহযোগী মেটার সঙ্গে মিলে একটি ভারত-কেন্দ্রিক এআই যৌথ উদ্যোগ শুরু করছি। আমরা চাই ওপেন-সোর্স এআই মডেলকে রিলায়েন্সের খাতভিত্তিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে ভারতের জন্য স্বনির্ভর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান তৈরি করতে।”
এই ভেঞ্চারের মাধ্যমে রিলায়েন্স তাদের শক্তি, টেলিকম, খুচরা ব্যবসা, মিডিয়া ও উৎপাদন খাতে এআই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দক্ষতা বাড়াতে এবং নতুন সমাধান বাজারে আনতে চায়।
মেটার প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মার্ক জাকারবার্গ বলেন, “মেটা ও রিলায়েন্স একসঙ্গে ভারতের ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের কাছে আমাদের ওপেন-সোর্স এআই মডেল পৌঁছে দেবে। আমাদের Llama মডেল ইতিমধ্যেই দেখিয়েছে কীভাবে এআই মানবসৃষ্টিশীলতা, উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবন বাড়াতে পারে। রিলায়েন্সের পরিসর ও পৌঁছনের কারণে এই প্রযুক্তি ভারতের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হবে।”
জাকারবার্গ আরও যোগ করেন, “এই ভেঞ্চারের মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যতের এক স্বপ্ন তৈরি করছি যেখানে প্রতিটি উদ্যোক্তা, স্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠান এআই টুলস ব্যবহার করে সাফল্য অর্জন করতে পারবে। এটা কেবল শুরু।”
রিলায়েন্স গুগলের সঙ্গেও সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। উভয় সংস্থা মিলে গুজরাটের জামনগরে এক্সক্লুসিভ ক্লাউড রিজিয়ন তৈরি করছে, যা কেবল রিলায়েন্সের জন্য নির্ধারিত হবে। এটি রিলায়েন্সের নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প দ্বারা চালিত হবে এবং জিওর উন্নত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বলেন, “রিলায়েন্সের সবচেয়ে বড় পাবলিক ক্লাউড পার্টনার হিসেবে আমরা শুধু গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্কলোডই সামলাচ্ছি না, বরং উন্নত এআই প্রকল্পেও একসঙ্গে উদ্ভাবন করছি। এই নতুন ক্লাউড রিজিয়ন রিলায়েন্সকে বিশ্বমানের কম্পিউটিং শক্তি দেবে, তাও আবার টেকসই উপায়ে।”
এই অবকাঠামোগত উন্নয়ন রিলায়েন্সকে ভারতের ভেতরে এআই-চালিত সমাধান দ্রুত বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করবে।
মুকেশ আম্বানি AGM-এ আরও একটি বড় ঘোষণা করেন—রিলায়েন্স ইন্টেলিজেন্স নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সহায়ক সংস্থা চালু হচ্ছে। এই সংস্থা রিলায়েন্সের অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় এআই একীভূত করার পাশাপাশি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর সমাধান তৈরি করবে।
এর মাধ্যমে খুচরা, আর্থিক পরিষেবা, জ্বালানি, টেলিকম এবং ডিজিটাল বিনোদন খাতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রিলায়েন্সের এআই-কেন্দ্রিক এই ঘোষণাগুলো সংস্থার বৃহত্তর রূপকল্পকে সামনে নিয়ে এসেছে—প্রতিটি ব্যবসায় এআইকে একীভূত করা। গুগলের ক্লাউড দক্ষতা এবং মেটার ওপেন-সোর্স মডেলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রিলায়েন্স নিজেকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে যেখানে বৈশ্বিক প্রযুক্তি ও ভারতীয় উদ্ভাবনের মেলবন্ধন ঘটছে।
বিশ্বজুড়ে এআই যখন দ্রুত শিল্পখাতের ধরন পাল্টে দিচ্ছে, তখন রিলায়েন্সের এই পদক্ষেপ কেবল ভারতের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক স্তরেও এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বিমুখী অংশীদারিত্ব ভারতকে শুধু এআই ভোক্তা নয়, বরং এআই নির্মাতা ও উদ্ভাবক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করবে।
১. অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন: নতুন ভেঞ্চার ভারতের মতো বৈচিত্র্যময় দেশে সহজলভ্য এআই সমাধান পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে।
২. টেকসই অবকাঠামো: নবায়নযোগ্য শক্তি দ্বারা চালিত ক্লাউড রিজিয়ন ভারতের সবুজ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৩. প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলিও এআই সুবিধা নিতে পারবে, ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
৪. বিশ্ব নেতৃত্বের পথে ভারত: মেটা ও গুগলের মতো প্রযুক্তি জায়ান্টদের সঙ্গে হাত মেলানো ভারতের জন্য বৈশ্বিক প্রযুক্তি মানচিত্রে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিচ্ছে।
৪৮তম AGM-এ ঘোষিত এই পদক্ষেপগুলো স্পষ্ট করে যে রিলায়েন্স কেবল দেশের বৃহত্তম ব্যবসায়িক সংস্থা হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। বরং, তারা এআই-এর মাধ্যমে ভারতকে এক নতুন প্রযুক্তি-চালিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
মেটা ও গুগলের মতো বৈশ্বিক নেতাদের সঙ্গে সহযোগিতা দেখিয়ে দিয়েছে, ভারতের আগামী প্রবৃদ্ধি কেবল অর্থনীতির ওপর নির্ভর করবে না—বরং এআই হবে তার চালিকাশক্তি।