নয়াদিল্লি: ভূরাজনীতি, বিশ্বশক্তির টানাপোড়েন এবং আন্তর্জাতিক চাপ এই তিনের মাঝে ভারতীয় জ্বালানি নীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। শিল্পদিগ্গজ রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে যে তারা আর রাশিয়ান ক্রুড অয়েল আমদানি করবে না। ইতিমধ্যেই ভারতীয় সরকারি তেল সংস্থাগুলো (PSUs) ধীরে ধীরে রাশিয়ান তেল আমদানি কমাতে শুরু করেছে, এবং সেই তালিকায় এবার দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি পরিশোধনকারী সংস্থারও নাম যুক্ত হলো।
মাত্র গত দুই বছর আগেও ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাশিয়ান তেল আমদানিকারক দেশ হয়ে উঠেছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকায় পশ্চিমা দেশগুলো যেখানে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়, সেখানে ভারত বিপরীত কৌশল নেয় সস্তা মূল্য সুবিধা কাজে লাগিয়ে ব্যাপক রাশিয়ান তেল কিনে পরিশোধন ও রপ্তানি করে। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারবার বলেছিলেন, “ভারতের জ্বালানি নীতি শুধুমাত্র ভারতের জনগণের স্বার্থে তৈরি হবে।”
প্যান কার্ড জালিয়াতি বাড়ছে! এখনই ক্রেডিট রিপোর্ট চেক করুন অনলাইনে
কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছে মার্কিন নির্বাচন ও নেতৃত্বের পরিবর্তনের পর। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই রাশিয়া সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতও সেই চাপের বাইরে নয়। আর রিলায়েন্সের সিদ্ধান্ত সেই ভূরাজনৈতিক ইঙ্গিতকে আরও স্পষ্ট করে তুলল।
তেল শিল্পের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এত বড় কৌশলগত সিদ্ধান্ত হালকাভাবে নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ রিলায়েন্সের জন্য রাশিয়ান তেল ছিল অত্যন্ত লাভজনক সস্তা দামে সংগ্রহ করে ডিজেল, পেট্রল ও এভিয়েশন ফিউয়েল রফতানির মাধ্যমে বিশাল মুনাফা আসছিল। তবুও যখন সংস্থাটি আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে, তখন আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক সমঝোতাকে বাদ দিয়ে দেখা যায় না।
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনেও শুরু হয়েছে আক্রমণ–প্রতিআক্রমণ। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে মোদী সরকার আমেরিকার চাপের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে পারে না। রিলায়েন্সের ঘোষণার পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে কংগ্রেস সমর্থকদের দাবি “রাহুল গান্ধী আবারও ঠিক প্রমাণিত হলেন”। অনেকে সরাসরি প্রশ্ন তুলছেন “রাশিয়ার তেল থেকে সরে দাঁড়ানো কি মোদীর কূটনৈতিক অবস্থান থেকে সরাসরি ট্রাম্পের জয়ে আত্মসমর্পণ?”
রাশিয়ান তেল বন্ধ হলে বিশ্ববাজারে যে তুলনামূলক বেশি দামে তেল কিনতে হবে, তার ফলে পেট্রল–ডিজেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক চাপ মানতে গিয়ে দেশের জনগণের পকেটে বাড়তি চাপ পড়লে সরকারকে রাজনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হতে পারে। তবে অন্যমতও রয়েছে। কূটনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, ভারত মার্কিন বাজার, প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। সেই সম্পর্ক বজায় রাখা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দিক থেকেও জরুরি। তাদের মতে “এটি আদর্শবাদ নয়, বাস্তবনীতি।”
রিলায়েন্সের সিদ্ধান্তের প্রভাব শুধুমাত্র কূটনীতিতেই নয়, বিশ্বজ্বালানি বাজারেও পড়বে নিশ্চিতভাবেই। কারণ ভারত রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ গ্রাহক। ভারত পূর্ণাঙ্গভাবে রাশিয়া থেকে সরে গেলে আন্তর্জাতিক তেলের মূল্য ফের অস্থির হতে পারে। ফলে এখন নজর শিল্প, অর্থনীতি ও রাজনীতির দিকে রাশিয়ান তেলের যুগ থেকে সরে গিয়ে ভারত কোন কৌশল নেয়? এবং শেষ পর্যন্ত এর প্রভাব সাধারণ মানুষের গ্যাস, ডিজেল ও পেট্রলের দামে কতটা পড়ে?


