নতুন গবেষণা, উন্নয়ন ও উদ্ভাবন (RDI SchemeI) প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের স্টার্টআপ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ১ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, রোবটিক্সসহ নানা উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গবেষণা ও উদ্ভাবনকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে উচ্চমানের পণ্য এবং পরিষেবা উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে এবং ভারতকে বৈশ্বিক প্রযুক্তি মানচিত্রে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
ভারতে মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) মাত্র ০.৬৫ শতাংশ গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) ব্যয় হয়, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় অনেক কম। বিশ্বে এই হার গড়ে প্রায় ২.৭ শতাংশ। যেমন, ইজরায়েল ৬.৩ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ৫ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্র ৩.৬ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ২.৯ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুর ২.২ শতাংশ ব্যয় করে। ভারতের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও তুলনামূলকভাবে কম, কারণ অনেক কোম্পানি এখনও গবেষণাকে খরচ হিসেবে দেখে, বিনিয়োগ হিসেবে নয়।
একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, ‘‘গবেষণায় বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নতুন পণ্য এবং পরিষেবা বাজারে আনার জন্য সহায়তা করে। বেসরকারি খাত এবং স্টার্টআপগুলোর জন্য এটি বড় সুযোগ।’’
২০১৬ সালে চালু হওয়া স্টার্টআপ ইন্ডিয়া উদ্যোগের পর থেকে সরকার নতুন উদ্যোগ ও প্রযুক্তি খাতকে উৎসাহিত করতে ধারাবাহিকভাবে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। RDI প্রকল্প মূলত বেসরকারি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য অর্থায়নের চ্যালেঞ্জগুলো দূর করতে তৈরি করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বা পুনরায় অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হবে, যা প্রায় শূন্য বা একেবারে কম সুদে পাওয়া যাবে। স্টার্টআপগুলোর জন্য ইক্যুইটির মাধ্যমে অর্থায়নের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
মোট ১ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে প্রথম ধাপে ২০ হাজার কোটি টাকা চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে। বাকি অর্থ বিভিন্ন উৎস থেকে যেমন, ডিপ-টেক ফান্ড অব ফান্ডস (Deep Tech Fund of Funds)-এর মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও আনতে পারবেন।
একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, ‘‘যে কোনো মন্ত্রণালয় চাইলে তাদের পছন্দের প্রযুক্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় আনতে পারে। সেই মন্ত্রণালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরে প্রস্তাব পাঠাবে, সেখান থেকে বিবেচনা করা হবে।’’
প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান জাতীয় গবেষণা ফাউন্ডেশন (ANRF)-এর পরিচালন পর্ষদ এই প্রকল্পের কৌশলগত দিকনির্দেশনা দেবে। ANRF-এর এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল প্রকল্পের গাইডলাইন অনুমোদন করবে এবং দ্বিতীয় স্তরের ফান্ড ম্যানেজার, সেক্টর ও প্রকল্পের ধরন ঠিক করবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বাধীন সচিব পর্যায়ের এক ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী প্রকল্পের পরিবর্তন, নতুন সেক্টর এবং প্রকল্প অনুমোদন, দ্বিতীয় স্তরের ফান্ড ম্যানেজার বাছাই এবং প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকবে।
সরকার ANRF-এর অধীনে স্পেশাল পারপাস ফান্ডে ৫০ বছরের জন্য সুদমুক্ত ঋণ দেবে। এই ফান্ড দ্বিতীয় স্তরের ফান্ড ম্যানেজারদের অর্থ দেবে। দ্বিতীয় স্তরের ফান্ড ম্যানেজার হিসেবে বিকল্প বিনিয়োগ তহবিল (AIF), নন-ব্যাংকিং ফাইনান্স কোম্পানি (NBFC) বা ফোকাসড রিসার্চ অর্গানাইজেশন থাকতেও পারে।
এই ফান্ড ম্যানেজারদের বিনিয়োগ কমিটি থাকবে, যেখানে প্রযুক্তি, ফিনান্স, একাডেমিয়া এবং প্রাইভেট সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। তারাই প্রকল্প বাছাই এবং তহবিল বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে একটি স্বতন্ত্র এবং কার্যকর R&D ইকোসিস্টেম তৈরি হবে। কর্মকর্তারা আশা প্রকাশ করেছেন, এটি দেশের গবেষণা এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন গতি আনবে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভারতকে আরও শক্ত অবস্থানে নিয়ে আসবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর এই প্রকল্পের নোডাল দপ্তর হিসেবে কাজ করবে এবং বিস্তারিত গাইডলাইন শীঘ্রই প্রকাশ করবে। গাইডলাইনে মূলত মূলধন পুনঃচক্রায়ন, বেসরকারি খাতের জন্য টেকসই ফান্ডিং মডেল এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি, সাইবার সিকিউরিটি, ন্যানো টেকনোলজি, এবং সাস্টেইনেবল এনার্জি-সহ বিভিন্ন ‘‘সানরাইজ সেক্টর’’-এ দেশীয় সক্ষমতা তৈরি হবে। এতে দেশের যুব সমাজের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, উদ্ভাবন-ভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হবে এবং ভারত ‘ভিশন ২০৪৭’-এর লক্ষ্যে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।