‘বাই নাও, পে লেটার’ স্কিম (BNPL Schemes) ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে একটি জনপ্রিয় পেমেন্ট বিকল্প হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালে এই খাতের বাজার মূল্য ৩০.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৮.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২০.৫২%। তবে, এই দ্রুত বর্ধনশীল খাতের উপর ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (RBI) এবং সরকার তীক্ষ্ণ নজর রাখছে, যাতে ভোক্তাদের সুরক্ষা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। ২০২৫ সালে আরবিআই বিএনপিএল স্কিমের জন্য নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে, যা ফিনটেক কোম্পানিগুলির ব্যবসায়িক মডেল এবং ভোক্তাদের অভিজ্ঞতার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। এই প্রতিবেদনে বিএনপিএল স্কিম নিয়ে সরকার ও আরবিআই-এর অবস্থান এবং বাংলার প্রেক্ষাপটে এর তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা হল।
আরবিআই-এর নিয়ন্ত্রণ কাঠামো
আরবিআই ২০২৫ সালে তার ‘পেমেন্টস ভিশন ২০২৫’ নথির মাধ্যমে বিএনপিএল স্কিমের উপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। এই নথিতে ডিজিটাল পেমেন্টকে সকলের জন্য নিরাপদ, সুলভ এবং অ্যাক্সেসযোগ্য করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আরবিআই বিএনপিএল স্কিমের দ্রুত বিস্তারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে ভোক্তাদের অতিরিক্ত ঋণের ঝুঁকি এবং আর্থিক সাক্ষরতার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে আরবিআই অ-ব্যাঙ্কিং বিএনপিএল প্রদানকারীদের প্রিপেইড পেমেন্ট ইন্সট্রুমেন্ট (পিপিআই) যেমন ডিজিটাল ওয়ালেটে ক্রেডিট লাইন লোড করা নিষিদ্ধ করেছিল। ২০২৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়েছে, এবং ফিনটেক কোম্পানিগুলিকে তাদের ব্যবসায়িক মডেল পুনর্গঠন করতে বাধ্য করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জেস্টমানি এবং ফ্রিচার্জ পে লেটারের মতো প্ল্যাটফর্ম উচ্চ ডিফল্ট রেট এবং নিয়ন্ত্রক চাপের কারণে ২০২৪ সালে বন্ধ হয়ে গেছে।
ভোক্তা সুরক্ষা ও স্বচ্ছতা
আরবিআই-এর প্রধান উদ্বেগ হল ভোক্তাদের অতিরিক্ত ঋণের ফাঁদে পড়া এবং স্বচ্ছতার অভাব। বিএনপিএল স্কিমগুলি সাধারণত কোনো সুদ ছাড়াই কিস্তিতে পেমেন্টের সুযোগ দেয়, তবে দেরিতে পেমেন্টের ক্ষেত্রে উচ্চ জরিমানা এবং সুদ আরোপ করা হয়। ২০২৫ সালে আরবিআই বিএনপিএল প্রদানকারীদের কঠোর কেওয়াইসি (নো ইয়োর কাস্টমার) এবং ক্রেডিট রিপোর্টিং নিয়ম মেনে চলতে নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়াও, ভোক্তাদের জন্য শর্তাবলী এবং ফি সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য প্রদানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। আরবিআই-এর মতে, বিএনপিএল প্ল্যাটফর্মগুলিকে ঋণ প্রদানের সময় ব্যাঙ্ক এবং নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি)-এর মতো একই নিয়ম মানতে হবে।
বিএনপিএল-এর বিস্তার ও বাংলার প্রেক্ষাপট
ভারতে বিএনপিএল সেবাগুলি কেবল ই-কমার্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ভ্রমণের মতো খাতেও প্রসারিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জেস্টমানি স্কুলের ফি-এর জন্য কিস্তির সুবিধা দিয়েছে, যখন বাজাজ ফিনসার্ভ চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য বিএনপিএল সমাধান চালু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ই-কমার্স এবং ডিজিটাল পেমেন্ট দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে, বিএনপিএল সেবাগুলি তরুণ জনগোষ্ঠী এবং ছোট ব্যবসায়ীদের মধ্যে জনপ্রিয়। কলকাতা এবং শিলিগুড়ির মতো শহরে অ্যামাজন পে লেটার এবং ফ্লিপকার্ট পে লেটারের মতো সেবাগুলি ক্রেতাদের জন্য কেনাকাটা সহজ করছে। তবে, আরবিআই-এর কঠোর নির্দেশিকার কারণে, এই প্ল্যাটফর্মগুলি এখন ব্যাঙ্কের সঙ্গে অংশীদারিত্বের উপর বেশি নির্ভর করছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আরবিআই-এর নিয়ন্ত্রণ বিএনপিএল স্কিমের জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। উচ্চ ডিফল্ট রেট, যেমন জেস্টমানির ১৩% ডিফল্ট রেট, ফিনটেক কোম্পানিগুলির জন্য লাভজনকতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও, ক্রেডিট রিপোর্টিং এবং কেওয়াইসি নিয়ম মেনে চলতে গিয়ে অনেক ছোট ফিনটেক কোম্পানি বাজার থেকে বেরিয়ে গেছে বা বড় ব্যাঙ্কের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। তবে, আরবিআই-এর নিয়ন্ত্রণের ফলে বিএনপিএল সেবাগুলি আরও স্বচ্ছ এবং নিরাপদ হচ্ছে, যা ভোক্তাদের আস্থা বাড়াচ্ছে।
বাংলার প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে কলকাতার মতো শহরে, বিএনপিএল সেবাগুলি ছোট ব্যবসায়ী এবং তরুণ ক্রেতাদের জন্য সুবিধাজনক। তবে, আরবিআই-এর নির্দেশিকা এই সেবাগুলির প্রসারকে কিছুটা সীমিত করতে পারে, কারণ ব্যাঙ্ক-ভিত্তিক বিএনপিএল মডেলগুলি এখন প্রাধান্য পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক ২০২৫ সালে তার পে লেটার সেবা বন্ধ করেছে, যা ভোক্তাদের বিকল্প পেমেন্ট পদ্ধতিতে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করেছে।
২০২৫ সালে ভারত সরকার এবং আরবিআই বিএনপিএল স্কিমের দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভোক্তা সুরক্ষা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। আরবিআই-এর কঠোর নির্দেশিকা ফিনটেক কোম্পানিগুলির জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করলেও, এটি দীর্ঘমেয়াদে স্বচ্ছতা এবং নির্ভরযোগ্যতা বাড়াবে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতা এবং অন্যান্য শহরে, বিএনপিএল সেবাগুলি ক্রেতাদের জন্য সুবিধাজনক হলেও, নিয়ন্ত্রক পরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের নতুন মডেলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। সরকার এবং আরবিআই-এর এই ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।