আগামী অক্টোবর মাসের মুদ্রানীতি বৈঠকে সুদের হার কমানোর সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (SBI)। ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক এক অর্থনৈতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৫-এ খুচরা মূল্যস্ফীতি (Retail Inflation) আবার ২ শতাংশের উপরে উঠতে পারে, যা প্রায় ২.৩ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। এই পূর্বাভাস আসে এমন সময়ে, যখন গত জুলাই মাসে খুচরা মূল্যস্ফীতি ৯৮ মাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল — ১.৫৫ শতাংশে। জুনে যেখানে এই হার ছিল ২.১০ শতাংশ, সেখানে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে তা ছিল ৩.৬০ শতাংশ।
খাদ্যদ্রব্যের দামে বড় পতনেই জুলাইয়ের মুদ্রাস্ফীতি কমে রেকর্ড পর্যায়ে:
জুলাই মাসের মুদ্রাস্ফীতি কমার পেছনে প্রধান কারণ ছিল খাদ্যদ্রব্যের দামে বড় ধরনের পতন। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি নেমে গিয়েছিল -১.৭৬ শতাংশে, যা জানুয়ারি ২০১৯-এর পর ৭৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থাৎ, বাজারে খাদ্যদ্রব্যের গড় দাম এক বছরের আগের তুলনায় বাস্তব অর্থে কমেছে।
মূল (Core) মুদ্রাস্ফীতি — যেখানে খাদ্য ও জ্বালানি খাত বাদ দিয়ে গণনা করা হয় — সেটিও কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৯৪ শতাংশে, যা ছ’মাসের মধ্যে প্রথমবার ৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যদি সোনার দাম বাদ দিয়ে মূল মুদ্রাস্ফীতি ধরা হয়, তবে হার আরও কম — ২.৯৬ শতাংশ, যা সাধারণ মূল সিপিআই (CPI) মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় প্রায় ১০০ বেসিস পয়েন্ট নিচে।
অক্টোবর নয়, ডিসেম্বরেও সুদের হার কমানো কঠিন হতে পারে:
এসবিআই-এর প্রতিবেদন শুধু অক্টোবর মাসেই নয়, ডিসেম্বরের মুদ্রানীতিতেও হার কমানোর সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের জিডিপি বৃদ্ধির হার যদি মজবুত থাকে, তাহলে মুদ্রানীতি কমিটি (MPC) হয়তো সুদের হার কমানোর পথে হাঁটবে না। প্রতিবেদনে সরাসরি বলা হয়েছে — “অক্টোবরে হার কমা কঠিন। এমনকি ডিসেম্বরে হার কমানোও কিছুটা কঠিন দেখাচ্ছে।”
জুনে কমেছে, আগস্টে বিরতি:
মুদ্রানীতি কমিটি সর্বশেষ সুদের হার কমিয়েছিল ২০২৫ সালের জুনে। তবে আগস্টে তারা হার কমানোর পরিবর্তে বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জুন মাসে হার কমানোর পর থেকেই দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ডের (১০ বছরের) আয় কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। জুলাই মাসে যেখানে ১০ বছরের সরকারি বন্ডের ফলন ছিল প্রায় ৬.৩০ শতাংশ, বর্তমানে তা বেড়ে ৬.৪৫ শতাংশের বেশি হয়েছে।
বন্ডের ফলন চাপে:
এসবিআই-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মার্কিন শুল্কসংক্রান্ত (US Tariff) অনিশ্চয়তা দূর না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় বন্ডের ফলন নেমে আসার সম্ভাবনা কম। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। ফলে, সরকারি ঋণের খরচ বাড়ছে এবং বাজারে বন্ডের দামের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফলন বক্ররেখাকে (Yield Curve) একটি ‘পাবলিক গুড’ হিসেবে দেখা জরুরি। এর মানে, একটি সুস্থ ফলন কাঠামো পুরো অর্থনীতির জন্যই উপকারী। তবে ভারতের ঋণপত্র বাজারে অংশগ্রহণকারীরা ভিন্ন ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করে থাকেন, যা ফলন কাঠামোকে কখনও কখনও অস্থির করে তোলে।
মুদ্রাস্ফীতির চাপ ও আরবিআই-এর দ্বিধা:
বর্তমান পরিস্থিতিতে আরবিআই-এর জন্য সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে, জুলাই মাসের কম মুদ্রাস্ফীতি নীতিনির্ধারকদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল, কিন্তু আগস্টে মুদ্রাস্ফীতি আবার বাড়ার সম্ভাবনা তাদের সতর্ক করছে। তাছাড়া, সুদের হার কমানো মানে অর্থনীতিতে আরও তরলতা ঢুকবে, যা পরবর্তীতে মুদ্রাস্ফীতিকে আবারও উস্কে দিতে পারে।
এসবিআই-এর মতে, মূল মুদ্রাস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এলেও খাদ্যদ্রব্যের দামে হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি বা আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।
বাজারের নজর এখন অক্টোবরের নীতিগত বৈঠকে:
বিনিয়োগকারী ও শিল্পমহল এখন অপেক্ষায় রয়েছে অক্টোবরের আরবিআই নীতিগত বৈঠকের জন্য। শেয়ার বাজার ও বন্ড বাজারে ইতিমধ্যেই এই সম্ভাব্য স্থিতাবস্থার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরবিআই যদি সুদের হার স্থিতাবস্থা বজায় রাখে, তবে বাজার কিছুটা স্থির থাকতে পারে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের জন্য ঋণের খরচ কিছুদিন আরও বেশি থাকবে।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ:
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতের জন্য আগামী কয়েক মাসে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে —
1. মুদ্রাস্ফীতির দিকনির্দেশনা: খাদ্য ও জ্বালানির দাম কীভাবে ওঠানামা করে, সেটাই নির্ধারণ করবে নীতি শিথিল হবে কি না।
2. আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: মার্কিন শুল্কনীতি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা সরাসরি ভারতের বন্ড বাজার ও বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
3. জিডিপি বৃদ্ধির গতি: যদি অর্থনীতি প্রত্যাশার তুলনায় বেশি দ্রুত বাড়তে থাকে, তবে আরবিআই হয়তো মুদ্রানীতি কঠোর রাখবে।
সব মিলিয়ে, এসবিআই-এর প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, অক্টোবর বা ডিসেম্বর — দুটো ক্ষেত্রেই সুদের হার কমার সম্ভাবনা এখন খুবই কম। আরবিআই-এর প্রধান লক্ষ্য থাকবে মুদ্রাস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা ও বাজারে দীর্ঘমেয়াদি আস্থা নিশ্চিত করা।