শুক্রবার, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (RBI) ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে ১,০০,০১০ কোটি টাকা প্রত্যাহার করেছে। এই পদক্ষেপটি সাত দিনের ভ্যারিয়েবল রেট রিভার্স রিপো (VRRR) নিলামের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। মূলত অতিরিক্ত তরলতা নিয়ন্ত্রণে আনাই এই পদক্ষেপের প্রধান উদ্দেশ্য।
আরবিআই এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই নিলামে মোট ১,৭০,৮৮০ কোটি টাকার দরপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১,০০,০১০ কোটি টাকা ৫.৪৭ শতাংশ কাট-অফ হারে গ্রহণ করেছে।
আরবিআই-এর মতে, জুলাই ৩ তারিখ পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রায় ৪.০৪ লাখ কোটি টাকার তরলতা উদ্বৃত্ত (surplus liquidity) ছিল। এমন পরিস্থিতিতে, অতিরিক্ত তারল্য অর্থনীতিতে অপ্রয়োজনীয় মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করতে পারে এবং স্বল্পমেয়াদি সুদের হারে অস্থিতিশীলতা আনতে পারে। ফলে, এই অর্থ প্রত্যাহারের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও জানিয়েছে, মাসের শেষে সরকারি বেতন ও পেনশনের মতো বিভিন্ন বিতরণ, সরকারি বন্ডের রিডেম্পশন ও কুপন পেমেন্টের কারণে বাজারে অতিরিক্ত নগদ অর্থ প্রবেশ করেছিল। এর আগেও, গত সপ্তাহে আরবিআই VRRR নিলামের মাধ্যমে ৮৪,৯৭৫ কোটি টাকা প্রত্যাহার করেছিল। কিন্তু এরপরও উদ্বৃত্ত তরলতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল, যা আরও একবার পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করে।
আরবিআই নিয়মিত VRRR নিলামের মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমের তরলতা পরিচালনা করে এবং স্বল্পমেয়াদি সুদের হারকে তাদের আর্থিক নীতি অনুযায়ী স্থিতিশীল রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপের ফলে রাতারাতি সুদের হারে সামান্য বৃদ্ধি হতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের খরচকেও প্রভাবিত করবে।
এই আর্থিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই, বুধবার আরবিআই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করেছে। সেই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী ১ জানুয়ারি, ২০২৬ থেকে আর কোনো ভাসমান হারের (floating rate) ঋণে প্রিপেমেন্ট বা আগাম পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত চার্জ নিতে পারবে না।
বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, ব্যক্তিগত (non-business) কাজে নেওয়া ভাসমান হারের ঋণে প্রিপেমেন্ট চার্জ নেওয়ার অনুমতি নেই। তবে নতুন নির্দেশনায় এই সুবিধার আওতা আরও বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নেওয়া ঋণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (MSE)-এর ঋণেও এই সুবিধা প্রযোজ্য হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসায়িক উদ্যোগ ও স্টার্টআপরা ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও বেশি স্বাধীনতা পাবে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনের সময় ঋণ পরিশোধ করতে পারবে এবং নতুন অর্থায়নের সুযোগ নিতে পারবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রিপেমেন্ট চার্জের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ দ্রুত পরিশোধ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে সুদের খরচ বেড়ে যায় এবং আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। এই নতুন নীতির মাধ্যমে সেই সমস্যা অনেকটাই লাঘব হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, আরবিআই-এর তরলতা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ ব্যাংকগুলোর জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যেসব ব্যাংক নগদ প্রবাহের ওপর বেশি নির্ভরশীল, তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনায় কিছুটা চাপ আসতে পারে। তাছাড়া, স্বল্পমেয়াদি মার্কেটে সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সাধারণ গ্রাহকের ঋণের খরচও সামান্য বাড়তে পারে।
তবে আরবিআই জানিয়েছে, এটি মূলত অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই এর মূল উদ্দেশ্য। বাজারে অপ্রয়োজনীয় তরলতা কমিয়ে সুদের হার ও মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজনীয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, এই ধরনের পদক্ষেপ যথাসময়ে গ্রহণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বদ্ধপরিকর, এই উদ্যোগ তা স্পষ্ট করে।
উল্লেখযোগ্য যে, রিজার্ভ ব্যাংক সম্প্রতি দেশের মুদ্রানীতি নিয়ে আরও সক্রিয় হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামা, আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ এবং দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থিক চাহিদা মেটাতে আরবিআই এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।
সব মিলিয়ে, আরবিআই-এর এই দুটি সিদ্ধান্ত — অর্থাৎ তরলতা প্রত্যাহার এবং প্রিপেমেন্ট চার্জ বাতিল — দেশের আর্থিক খাতে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন স্বল্পমেয়াদি সুদের হার ও তরলতার ওপর প্রভাব পড়বে, অন্যদিকে ঋণগ্রহীতাদের জন্য একটি স্বাচ্ছন্দ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে।
বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এই উদ্যোগের ফলে আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা ও গ্রাহকবান্ধবতা বৃদ্ধি পাবে, যা আগামী দিনে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।