সোনার ঋণে এবার বাধ্যতামূলক খাঁটি সোনা যাচাই

ভারতে সোনার ঋণের (Gold Loans) প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সোনার দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউ কেউ একই পরিমাণ সোনা থেকে বেশি মূল্য আদায় করছেন, আবার…

RBI Issues Draft Guidelines for Gold Loans

ভারতে সোনার ঋণের (Gold Loans) প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সোনার দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউ কেউ একই পরিমাণ সোনা থেকে বেশি মূল্য আদায় করছেন, আবার অনেকে আর্থিক দুর্দশার কারণে তাদের সোনা বন্ধক দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য ফলাফল একই—সোনার ঋণের পরিমাণে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এই পটভূমিকায় ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) সোনার ঋণ সংক্রান্ত একটি খসড়া নির্দেশিকা জারি করেছে, যা গত ৯ এপ্রিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই নির্দেশিকার মূল লক্ষ্য হল ঋণ প্রদানের মান উন্নত করা, জামানত ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা এবং ঋণের তহবিলের শেষ-ব্যবহার নিরীক্ষণ করা।

এই খসড়া নির্দেশিকা ছোট ব্যাঙ্ক (এসএফবি), আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্ক (আরআরবি)—পেমেন্ট ব্যাঙ্ক বাদে—সহকারী ব্যাঙ্ক, নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি) এবং হাউজিং ফিনান্স কোম্পানিগুলির (এইচএফসি) জন্য প্রযোজ্য হবে। আরবিআই-এর এই পদক্ষেপ সোনার ঋণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করার প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে।

প্রমিত ধাতু পরীক্ষা: একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ

আরবিআই-এর অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হল সোনার ঋণে চাপযুক্ত সম্পদ তৈরির সম্ভাবনা। গত কয়েক বছরে একাধিক রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, মাঠ পর্যায়ের এজেন্টরা প্রায়ই গহনা জামানত হিসেবে গ্রহণের সময় সোনার গুণমান যথাযথভাবে পরীক্ষা না করে ঋণের প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আরবিআই এখন সোনার গুণমান নির্ধারণের জন্য একটি প্রমিত পরীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছে। খসড়ায় বলা হয়েছে, “ঋণদাতাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, জামানত হিসেবে দেওয়া সোনার বিশুদ্ধতা, মোট ওজন এবং নিট ওজন পরীক্ষার জন্য একটি প্রমিত পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এই পদ্ধতি ঋণদাতার সমস্ত শাখায় একইভাবে গ্রহণ করতে হবে।” এর ফলে সোনার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অভিন্নতা এবং নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নির্দেশিকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক

আরবিআই-এর খসড়া নির্দেশিকায় আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা সোনার ঋণের প্রক্রিয়াকে আরও নিয়ন্ত্রিত এবং স্বচ্ছ করবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • ঋণগ্রহীতার পরিশোধ ক্ষমতার সঙ্গে সংযোগ: ঋণের পরিমাণ ঋণগ্রহীতার আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
  • শেষ-ব্যবহার নিরীক্ষণ: ঋণদাতাদের উপযুক্ত সিস্টেম ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োগ করে ঋণের তহবিল কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা নিরীক্ষণ ও রেকর্ড করতে হবে।
  • একই জামানতের দ্বৈত ব্যবহার নিষিদ্ধ: একই সোনার জামানত ব্যবহার করে আয়-উৎপাদনমূলক এবং ভোগমূলক ঋণ একসঙ্গে প্রদান করা যাবে না।
  • মালিকানা স্পষ্ট না হলে ঋণ নয়: যে সোনার মালিকানা স্পষ্ট নয়, তার বিরুদ্ধে কোনও ঋণ অনুমোদন করা যাবে না।
  • ঋণ নবায়ন ও টপ-আপ: বিদ্যমান ঋণ ‘স্ট্যান্ডার্ড’ শ্রেণীভুক্ত হলেই কেবল নবায়ন বা টপ-আপ ঋণ অনুমোদন করা যাবে।
  • বুলেট পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ: বুলেট পরিশোধ ঋণের সর্বোচ্চ মেয়াদ ১২ মাস নির্ধারণ করা হয়েছে।
  • সহকারী ব্যাঙ্ক ও আরআরবি-র জন্য সীমা: সহকারী ব্যাঙ্ক এবং আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি প্রতি ঋণগ্রহীতার জন্য সর্বাধিক ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বুলেট পরিশোধ ঋণ প্রদান করতে পারবে।
  • জামানতের সীমা: প্রতি ঋণগ্রহীতার জন্য জামানত হিসেবে দেওয়া সোনার গহনা ও মুদ্রার মোট ওজন ১ কেজির বেশি হবে না।
  • মুদ্রার ওজন সীমা: জামানত হিসেবে দেওয়া মুদ্রার ওজন ৫০ গ্রামের বেশি হতে পারবে না।
  • গ্রহণযোগ্য মুদ্রা: কেবল ব্যাঙ্ক কর্তৃক বিশেষভাবে প্রস্তুত ২২ ক্যারেট বা তার বেশি বিশুদ্ধতার সোনার মুদ্রা জামানত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে।

কেন এই নির্দেশিকা জরুরি?

সোনার ঋণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর অপব্যবহারের ঝুঁকিও বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঋণের তহবিল অপ্রয়োজনীয় বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া, সোনার গুণমান পরীক্ষায় অভিন্নতার অভাবের কারণে ঋণদাতারা ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। আরবিআই-এর এই নতুন নির্দেশিকা এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। প্রমিত পরীক্ষার মাধ্যমে সোনার বিশুদ্ধতা ও ওজন নির্ধারণ করা হলে ঋণদাতারা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ঋণ প্রদান করতে পারবেন, যা জামানতের গুণমান নিয়ে অনিশ্চয়তা কমাবে।

Advertisements

শেষ-ব্যবহার নিরীক্ষণের উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে আরবিআই নিশ্চিত করতে চায় যে, ঋণের অর্থ অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এটি ব্যক্তিগত বা অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য অপব্যবহার হচ্ছে না। এই পদক্ষেপ ঋণগ্রহীতাদের ঋণের বোঝা থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি ঋণদাতাদের সম্পদের গুণমান বজায় রাখতে সাহায্য করবে।

বাজারে প্রভাব

এই নির্দেশিকা চূড়ান্ত হলে সোনার ঋণের বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। এনবিএফসি এবং সহকারী ব্যাঙ্কগুলির মতো প্রতিষ্ঠানগুলির উপর এর প্রভাব বেশি পড়বে, কারণ তারা সাধারণত সোনার ঋণের একটি বড় অংশ পরিচালনা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নিয়মগুলি প্রাথমিকভাবে ঋণদান প্রক্রিয়ায় কিছুটা কঠোরতা আনতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি বাজারের স্থিতিশীলতা বাড়াবে।

এই খসড়ার উপর জনসাধারণ এবং স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ করা হচ্ছে। মতামত পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত নির্দেশিকা প্রকাশ করা হবে। সোনার ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য এই নতুন নিয়মগুলি সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি, কারণ এটি তাদের ঋণের শর্ত এবং প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।