ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (RBI) রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাঙ্কগুলির ঋণ গ্রহণের খরচ কমবে এবং তারা সাধারণ গ্রাহকদের জন্য কম সুদে ঋণ দিতে পারবে, যার ফলে ঋণের EMI (সমান মাসিক কিস্তি) হ্রাস পাবে। আরবিআই গভর্নর সঞ্জয় মলহোত্রা আজ জানিয়েছেন, মানিটারি পলিসি কমিটি (এমপিসি) সর্বসম্মতভাবে রেপো রেট কমানোর পক্ষে ভোট দিয়েছে।
এটি এই বছরে দ্বিতীয়বার রেপো রেট কমানো হলো। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক এই হার ৬.২৫ শতাংশে নামিয়েছিল। রেপো রেট, যা ক্রয় চুক্তি হার নামেও পরিচিত, হলো আরবিআই-এর বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ দেওয়ার সময় ধার্য করা সুদের হার। এটি কমলে ব্যাঙ্কগুলি সাধারণত এই সুবিধা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়।
গভর্নরের বক্তব্য: বিশ্ব অর্থনীতির উদ্বেগ
গভর্নর মলহোত্রা বলেন, “অর্থবছরের শুরুটা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। আমরা বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতির ঝুঁকির উপর নজর রাখছি।” এই ঘোষণার কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের রপ্তানির উপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে। তিনি আরও বলেন, “বাণিজ্য ঘর্ষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা দেশীয় প্রবৃদ্ধিকেও বাধাগ্রস্ত করবে। উচ্চ শুল্ক নেট রপ্তানির উপর প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে সক্রিয়ভাবে আলোচনা করছে।”
তিনি জানান, বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাব এখনই পরিমাণগতভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। তবে, তিনি আশ্বাস দিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক দেশীয় প্রবৃদ্ধি পরিচালনার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নয়। কৃষি খাতের সম্ভাবনা উজ্জ্বল রয়েছে এবং উৎপাদন কার্যক্রমে পুনরুজ্জীবনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, “পরিষেবা খাতে স্থিতিস্থাপকতা অব্যাহত রয়েছে। শহুরে খরচে উত্থান দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে ঐচ্ছিক ব্যয়ে। ব্যাঙ্ক এবং কর্পোরেটদের ব্যালেন্স শিট সুস্থ রয়েছে।”
মূল্যস্ফীতি এবং খাদ্য মূল্য হ্রাস
গভর্নর জানান, এমপিসি লক্ষ্য করেছে যে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে লক্ষ্যমাত্রার নিচে রয়েছে এবং খাদ্যের দামে তীব্র পতন ঘটেছে। এই পরিস্থিতি রেপো রেট কমানোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থাকলেও, আমরা প্রবৃদ্ধি এবং স্থিতিশীলতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছি।”
EMI-এর উপর প্রভাব
রেপো রেট ৬%-এ নামার ফলে ব্যাঙ্কগুলি তাদের ঋণের সুদের হার কমাতে পারবে। এর ফলে গৃহঋণ, গাড়ির ঋণ বা ব্যক্তিগত ঋণের EMI হ্রাস পাবে। উদাহরণস্বরূপ, ২০ লক্ষ টাকার গৃহঋণের উপর ২৫ বেসিস পয়েন্ট হ্রাস মাসিক EMI-তে প্রায় ৫০০-৭০০ টাকা কমাতে পারে (২০ বছরের মেয়াদ ধরে)। এটি গ্রাহকদের জন্য আর্থিক স্বস্তি আনবে, বিশেষ করে যারা উচ্চ EMI-এর বোঝা বহন করছেন।
ট্রাম্পের শুল্ক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
মার্কিন প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতি ভারতের রপ্তানির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের উপর ২৬% আমদানি শুল্ক আরোপ করেছে, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০-৪০ বেসিস পয়েন্ট কমাতে পারে। গভর্নর মলহোত্রা বলেন, “এই শুল্কের প্রভাব আমাদের নেট রপ্তানিতে পড়বে। তবে, আমরা এটি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত।” তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক মূল্যস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য নীতি সামঞ্জস্য করছে।
অর্থনীতির ইতিবাচক দিক
গভর্নর জোর দিয়ে বলেন, কৃষি খাতে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। উৎপাদন কার্যক্রমে পুনরুজ্জীবনের লক্ষণ রয়েছে এবং পরিষেবা খাত শক্তিশালী অবস্থানে আছে। শহুরে গ্রাহকদের খরচ বাড়ছে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত। তিনি বলেন, “ব্যাঙ্ক এবং কর্পোরেটদের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো রয়েছে, যা অর্থনীতির ভিত মজবুত করছে।”
কেন রেপো রেট কমানো হলো?
এই বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারিতে রেপো রেট কমানোর পর, মূল্যস্ফীতি ৪% লক্ষ্যমাত্রার নিচে নেমে আসে। খাদ্যের দামে পতন এবং বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রবৃদ্ধি সমর্থনের জন্য আরবিআই এই পদক্ষেপ নিয়েছে। গভর্নর বলেন, “আমরা প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রাখতে এবং গ্রাহকদের স্বস্তি দিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তবে, তিনি সতর্ক করে বলেন, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের ঝুঁকি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াতে পারে।
গ্রাহকদের জন্য সুবিধা
রেপো রেট কমার ফলে ব্যাঙ্কগুলি শীঘ্রই তাদের ঋণের সুদের হার সামঞ্জস্য করতে পারে। এটি গৃহঋণ, গাড়ির ঋণ এবং ব্যক্তিগত ঋণ গ্রহীতাদের জন্য আর্থিক চাপ কমাবে। এছাড়া, ব্যবসায়ীরা কম সুদে ঋণ পেয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন, যা অর্থনীতিতে গতি আনবে।
আরবিআই-এর এই সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের শুল্ক নীতির প্রভাব মোকাবিলা এবং দেশীয় অর্থনীতিকে সমর্থন করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। EMI কমার ফলে গ্রাহকরা স্বস্তি পাবেন, এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে, বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতির উপর নজর রেখে আরবিআই ভবিষ্যতে নীতি সামঞ্জস্য করতে পারে।