ভারতের অনলাইন গেমিং শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খেল কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার গত সপ্তাহে একটি নতুন আইন জারি করেছে, যার মাধ্যমে রিয়েল-মানি ভিত্তিক অনলাইন গেম—যেমন রামি ও পোকার—নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকার এটিকে ‘সামাজিক অনিষ্ট রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ বলে ব্যাখ্যা করলেও, গেমিং শিল্প এবং বিনিয়োগকারীরা একে বিশাল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো আদালতের দ্বারস্থ হলো গেমিং কোম্পানি A23। কর্ণাটক হাইকোর্টে দাখিল করা এক পিটিশনে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, নতুন আইন বৈধ ব্যবসাকে অপরাধে পরিণত করছে। তাদের বক্তব্য, রামি ও পোকারের মতো গেম ‘দক্ষতা-ভিত্তিক খেলা’ (games of skill), সুতরাং এগুলোকে জুয়া হিসেবে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করা সাংবিধানিকভাবে অন্যায়।
কোম্পানির আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন, এই আইন কার্যকর হলে রাতারাতি বহু গেমিং কোম্পানিকে কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে, যা বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও ব্যবহারকারীদের জন্য বড় ধাক্কা হবে। তারা নতুন আইনটিকে “রাষ্ট্রের অযাচিত পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের ফসল” (product of state paternalism) বলে উল্লেখ করেছেন এবং আদালতের কাছে অনুরোধ করেছেন যে, দক্ষতা-ভিত্তিক গেমের ক্ষেত্রে এই আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হোক।
A23-এর ফাইলিং ২৮ আগস্ট তারিখে জমা দেওয়া হয়, যা এখনও সর্বজনীন হয়নি তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স তা পর্যালোচনা করেছে। A23 নিজেদেরকে ভারতের অন্যতম বৃহৎ অনলাইন গেমিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাবি করে, যেখানে ৭ কোটিরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে। কোম্পানিটি ভারতীয় ক্রিকেট তারকাদের বিজ্ঞাপনী সমর্থন ও ব্যাপক বিপণন কৌশলের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
এটি কেবল A23-এর সমস্যাই নয়—পুরো শিল্প এখন দোটানায়। বাজার গবেষণা অনুযায়ী, ভারতের অনলাইন গেমিং খাত ২০২৯ সালের মধ্যে ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পৌঁছাতে পারত। কিন্তু নতুন আইন কার্যকর হওয়ায় সেই সম্ভাবনা কার্যত স্থগিত হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব কোম্পানিতে টাইগার গ্লোবাল ও পিক XV পার্টনার্সের মতো ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছিল, তাদের জন্য এই ধাক্কা অপ্রত্যাশিত।
A23 যেখানে আদালতে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে শিল্পের অন্যান্য দুই বড় নাম—Dream11 এবং MPL—ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছে।
MPL ইতোমধ্যে সব রিয়েল-মানি গেম বন্ধ করে দিয়েছে। কোম্পানির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা কোনো আইনি চ্যালেঞ্জ করবে না। বরং তারা যে সমস্ত শিল্প সংস্থার সঙ্গে যুক্ত, তাদের পরামর্শ দিচ্ছে ভবিষ্যতে ‘ফ্রি-টু-প্লে’ মডেল বা বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক মডেলের ওপর জোর দিতে।
Dream11-এর অবস্থানও একই। তাদের সিইও হর্ষ জৈন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের আয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে।” তবে তিনি এটাও যোগ করেন যে, কোম্পানি এখন একটি নতুন কৌশল নিচ্ছে—“আমরা একটি মহান ভারতীয় স্পোর্টস কোম্পানি তৈরি করতে চাই, যা এআই ও ক্রিয়েটর ইকোনমির দ্বারা চালিত হবে।” Dream11 সরাসরি আইনি চ্যালেঞ্জে যেতে চাইছে না।
মোদী সরকার দীর্ঘদিন ধরেই মানি-বেসড অনলাইন গেম নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকারের যুক্তি, এই ধরনের খেলা নেশার মতো আসক্তি সৃষ্টি করে এবং আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় ডেকে আনে। আইনটি ঘোষণার সময় সরকার স্পষ্ট জানায় যে, তারা জনগণকে ‘সামাজিক অনিষ্ট’ থেকে রক্ষা করার দায়িত্ববোধ থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের অনলাইন গেমিং শিল্প অচলাবস্থায়। বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তুলছেন—এত বড় একটি বাজার হঠাৎ করে কীভাবে আইনি ঝুঁকির মুখে পড়ল? অপরদিকে উদ্যোক্তারা ভাবছেন, ফ্রি-টু-প্লে বা ই-স্পোর্টসকেন্দ্রিক ব্যবসায় মডেল কি ভবিষ্যতের পথ খুলে দিতে পারবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আদালত দক্ষতা-ভিত্তিক গেমের পক্ষ নিয়ে রায় দেয়, তাহলে শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু যদি নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে, তবে ভারতীয় গেমিং কোম্পানিগুলোকে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

আমাদের Google News এ ফলো করুন
২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।
