ভারতের বেসরকারি কর্পোরেট খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অনীহার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা—এমনই পর্যবেক্ষণ পেশ করেছে UBS Securities India। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে চলমান বাণিজ্য আলোচনার অনিশ্চয়তা ও চুক্তিসমূহের বিলম্ব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি করছে, যার ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলি দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি ব্যয় (Capex) থেকে পিছিয়ে রয়েছে।
UBS-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “কর্পোরেট ও বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাণিজ্য চুক্তি ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা কমাতে সাহায্য করে। এই অনিশ্চয়তা ভারতের বেসরকারি কর্পোরেট খাতের বিনিয়োগের ওপর বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এই প্রেক্ষিতে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন শনিবার দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে কর্পোরেট সংস্থাগুলির বিনিয়োগ অনীহা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “সরকারি স্তরে, কেন্দ্র ও রাজ্য—উভয়ই যখন প্রচুর পুঁজিবিনিয়োগ করছে, তখন বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কি সেই গতিতে এগোচ্ছে? কোভিড-পরবর্তী প্রথম কয়েক বছরে তো নয়ই।”
অর্থমন্ত্রী আরও জানান, “২০১৯ সালের পর ‘টুইন ব্যালান্স শিট’ সমস্যা সমাধান এবং কর্পোরেট ট্যাক্স হ্রাসের পর সংস্থাগুলির আর্থিক অবস্থা অনেকটাই সুস্থ হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই সংস্থাগুলি কি তাঁদের হাতে থাকা বিনিয়োগযোগ্য অর্থ (investable funds) প্যাসিভভাবে ধরে রেখেছে? এই অর্থ সক্রিয় উৎপাদনে বা কারখানার সম্প্রসারণে কাজে লাগানো হচ্ছে না কেন? এই বিষয়ে শিল্প মহলের সুনির্দিষ্ট মতামত প্রয়োজন।”
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে, সম্প্রতি ANI-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় শিল্প ও বণিক সংস্থা (CII)-এর প্রেসিডেন্ট রাজীব মেমানি জানান, কর্পোরেট পুঁজিবিনিয়োগ নিয়ে বর্তমান বাজারে যে ধরণের মন্দাভাব প্রচলিত, তা আংশিক সত্য। তিনি বলেন, “যদিও গত ৬-৮ মাসে খানিকটা মন্থরতা দেখা গেছে, তবে এটি গঠনগত নয় বরং বহিঃপ্রভাবজনিত। বাস্তব হলো—তেল ও গ্যাস, বিদ্যুৎ, গাড়ি শিল্প এবং কমোডিটি খাতসহ একাধিক ক্ষেত্রে বেসরকারি Capex ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
CII প্রেসিডেন্টের মতে, গত পাঁচ বছরে (FY21 থেকে FY25E পর্যন্ত) ভারতের বেসরকারি পুঁজিবিনিয়োগ ১৯.৮ শতাংশ যৌগিক বার্ষিক বৃদ্ধির হার (CAGR) অনুসরণ করেছে। এই বিনিয়োগ প্রধানত কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতের দ্বারা চালিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
তেল ও গ্যাস খাত: পরিকাঠামো এবং রিফাইনারি সম্প্রসারণে ব্যাপক বিনিয়োগ।
বিদ্যুৎ খাত: নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে গতি, বিশেষত সৌর ও বায়ু শক্তিতে।
গাড়ি শিল্প: বৈদ্যুতিক যানবাহনের (EV) উৎপাদন ও চার্জিং পরিকাঠামোতে নতুন Capex।
কমোডিটি খাত: ধাতু, সিমেন্ট এবং রাসায়নিক খাতে উত্পাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি।
বিনিয়োগে দ্বিধার কারণ:
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আজকের বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশে—যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রূপান্তর, এবং উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে চুক্তির দীর্ঘসূত্রিতা কর্পোরেট পরিকল্পনায় স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে দিচ্ছে না।
বিশেষ করে ভারতের মতো অর্থনীতিতে, যেখানে একাধিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি আলোচনাধীন রয়েছে—উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে FTA, ব্রিটেনের সঙ্গে চুক্তি, এবং ভারত-ইউএস বাণিজ্য আলোচনা—সেখানকার সংস্থাগুলি দ্বিধায় পড়ছে: চুক্তির পর শুল্ক কাঠামো কেমন হবে, নতুন বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে কি না, এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার অভাব তাদের পরিকল্পিত Capex-এ প্রভাব ফেলছে।
ভবিষ্যতের দিশা কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি দ্রুত ও স্বচ্ছ বাণিজ্য নীতিমালা কার্যকর করে এবং চুক্তির বাস্তবায়নে গতি আনে, তাহলে কর্পোরেট বিনিয়োগে নতুন গতি আসতে পারে। এর পাশাপাশি, বেসরকারি খাতের নেতৃস্থানীয়দেরও উচিত—বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের সদ্ব্যবহার করে উৎপাদনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া।
বর্তমানে সরকার পক্ষ থেকে বড় পরিকাঠামো প্রকল্প, স্কিম-ভিত্তিক উৎপাদন উৎসাহ (PLI), কর রেয়াত, এবং স্থিতিশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই প্রয়াসকে সমর্থন জানিয়ে যদি কর্পোরেট সংস্থাগুলি Capex বাড়ায়, তবে দেশের অর্থনীতি আরও দৃঢ় ভিতের উপর দাঁড়াতে পারবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তির অনিশ্চয়তা, বাজার প্রবেশের ঝুঁকি এবং ভবিষ্যৎ নীতির অস্পষ্টতা—এই তিন প্রধান কারণে ভারতের কর্পোরেট জগতে পুঁজিবিনিয়োগের গতি মন্থর। তবে সরকারি উদ্যোগ ও নির্বাচিত খাতে ইতিবাচক প্রবণতা আশা জাগায়। এখন সময়—এই অনিশ্চয়তার দ্বিধা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার।