স্বাস্থ্য বীমা (Health insurance) বর্তমানে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আর্থিক সুরক্ষা হিসেবে বিবেচিত। হঠাৎ কোনো অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় বিশাল চিকিৎসার খরচ এড়াতে স্বাস্থ্য বীমা একটি বড় সহায়ক। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, আপনার বিদ্যমান স্বাস্থ্য বীমা পলিসি অন্য কোনো বীমা কোম্পানিতে স্থানান্তর বা “পোর্ট” করা সম্ভব।
পোর্টেবিলিটি বলতে মূলত বোঝানো হয়, কোনো গ্রাহক নিজের পুরনো স্বাস্থ্য বীমা পলিসি এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে সরিয়ে নিতে পারেন, যদি তিনি মনে করেন নতুন কোম্পানির পলিসি তার প্রয়োজন অনুযায়ী বেশি উপযোগী। যদিও এটি একটি ভালো সুবিধা, তবুও পলিসি পোর্ট করার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং জটিলতা সম্পর্কে জানা অত্যন্ত দরকার।
১. ডকুমেন্টেশন এবং সময় সংক্রান্ত জটিলতা:
পলিসি পোর্ট করার জন্য প্রয়োজন হয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি জমা দেওয়া। এর মধ্যে রয়েছে পূর্ববর্তী পলিসির বিবরণ, ক্লেইম হিস্ট্রি এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঘোষণা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বর্তমান পলিসির নবীকরণের অন্তত ৪৫ দিন আগে এবং ৬০ দিনের মধ্যে পোর্টের আবেদন করতে হয়। এই নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে চলতে ব্যর্থ হলে, পোর্টের প্রক্রিয়ায় দেরি বা বাতিল হতে পারে।
২. প্রিমিয়ামের আশ্চর্য চমক:
অনেক সময় গ্রাহকরা ভাবেন, পোর্ট করলে তাদের আগের সব সুবিধা হুবহু নতুন পলিসিতে পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বীমার লয়্যালটি ডিসকাউন্ট বা নির্দিষ্ট ফিচার যেমন ‘ডোমিসিলিয়ারি হসপিটালাইজেশন বেনিফিট’ নতুন পলিসিতে ট্রান্সফার হয় না। ফলে প্রিমিয়ামে হঠাৎ বৃদ্ধি বা নতুন সুবিধা না থাকার কারণে অনেকের জন্য এটি আর্থিকভাবে চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৩. ওয়েটিং পিরিয়ডের ফাঁদ:
ইনশিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া (IRDAI)-এর নিয়ম অনুযায়ী, পূর্ববর্তী পলিসির প্রি-এক্সিস্টিং ডিজিজের জন্য ক্রেডিট স্থানান্তর করা যায়। কিন্তু, নতুন কোম্পানি কিছু বিশেষ রোগের জন্য আবারও নতুন ওয়েটিং পিরিয়ড আরোপ করতে পারে। এর ফলে, পলিসি হোল্ডাররা কিছু সময়ের জন্য আংশিকভাবে আন্ডার-ইনসিউরড অবস্থায় থাকতে পারেন। তাই নতুন পলিসির ওয়েটিং পিরিয়ড ও শর্তাবলী ভালোভাবে যাচাই করা উচিত।
৪. আন্ডাররাইটিং ও রিজেকশন ঝুঁকি:
নতুন কোম্পানিতে পোর্ট করার সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আন্ডাররাইটিং প্রক্রিয়া। নতুন ইনসিউরার আপনার মেডিকেল ইতিহাস অনুযায়ী পোর্টের অনুরোধ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রাখে। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বা যারা হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিসের মতো জটিল রোগে ভুগছেন, তাদের পোর্টের আবেদন সহজে গ্রহণ নাও হতে পারে। অনেক সময় নতুন কোম্পানি প্রিমিয়াম বাড়িয়ে দিতে পারে বা কিছু রোগের ক্ষেত্রে এক্সক্লুশন বসিয়ে দিতে পারে।
৫. কাভারেজের ফাঁক এবং বেনিফিট কমে যাওয়া:
সব স্বাস্থ্য বীমা পলিসির কাভারেজ সমান নয়। উদাহরণস্বরূপ, করোনার আগে যারা ৩ লাখ টাকার একটি বেসিক মেডিকেল প্ল্যান কিনেছিলেন, তারা হয়তো পরবর্তীতে বুঝতে পারেন যে এটি পর্যাপ্ত নয়। পোর্ট করার সময় নতুন কোম্পানি বাধ্য যে অন্তত আপনার পুরনো কাভারেজ সমান পরিমাণের পলিসি দিতে হবে। তবে বেশি সুরক্ষার জন্য অনেকেই সুপার টপ-আপ বা টপ-আপ প্ল্যান নেন, যা তুলনামূলকভাবে কম খরচে বেশি কভারেজ দেয়।
তাই, শুধু পোর্ট করার সুবিধা দেখে তাড়াহুড়ো না করে, প্রতিটি দিক বিশ্লেষণ করা উচিত। যেমন — নতুন পলিসির প্রিমিয়াম, বেনিফিট, এক্সক্লুশন, ওয়েটিং পিরিয়ড এবং কোম্পানির ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেশিও।
স্বাস্থ্য বীমা পোর্ট করা মানে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী সর্বোত্তম পলিসি পাওয়ার একটি বড় সুযোগ। তবে ভুল সিদ্ধান্তের ফলে কাভারেজের ফাঁক, বাড়তি খরচ, বা পরবর্তী সময়ে আর্থিক সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে। তাই পোর্টের আগে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রতিটি শর্ত ভালোভাবে বোঝা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখুন, স্বাস্থ্য বীমা শুধু একটি আর্থিক পণ্য নয়, এটি আপনার এবং আপনার পরিবারের সুস্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ঢাল। সঠিক বেছে নিয়ে থাকুন সুরক্ষিত!