লন্ডনে ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, মোদী-স্টারমার কৌশলগত আলোচনা

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুধবার (২৩ জুলাই, ২০২৫) যুক্তরাজ্যে দুই দিনের সরকারি সফর (PM Modi in London) শুরু করেছেন। এই সফরের মূল লক্ষ্য হলো ভারত ও…

PM Modi in London: India-UK Free Trade Agreement Signing, Strategic Talks with Keir Starmer on Agenda

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুধবার (২৩ জুলাই, ২০২৫) যুক্তরাজ্যে দুই দিনের সরকারি সফর (PM Modi in London) শুরু করেছেন। এই সফরের মূল লক্ষ্য হলো ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রসারিত করা, বিশেষ করে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। এই সফরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), যা তিন বছরের দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত হয়েছে এবং বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চুক্তি ভারতের প্রায় ৯৯ শতাংশ রপ্তানির উপর শুল্ক হ্রাস করবে এবং যুক্তরাজ্যের ব্যবসায়ীদের জন্য ভারতে হুইস্কি, গাড়ি এবং অন্যান্য পণ্য রপ্তানি সহজতর করবে।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি: একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক
ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই চুক্তি ভারতের রপ্তানি, বিশেষ করে চামড়া, পাদুকা, টেক্সটাইল, খেলনা, রত্ন ও গহনার মতো শ্রমঘন পণ্যের জন্য বাজারে প্রবেশাধিকার উন্নত করবে। এছাড়া, যুক্তরাজ্য থেকে আমদানিকৃত পণ্য, যেমন হুইস্কি এবং বিলাসবহুল গাড়ি, ভারতে আরও সাশ্রয়ী হবে। এই চুক্তির লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা, যা ২০২৩-২৪ সালে ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।

   

বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল এবং তাঁর যুক্তরাজ্যের সমকক্ষ জোনাথন রেনল্ডস বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের উপস্থিতিতে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন বলে জানা গেছে। এই চুক্তির পাশাপাশি, একটি ডাবল কন্ট্রিবিউশন কনভেনশনও স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা যুক্তরাজ্যে কাজ করা ভারতীয় কর্মীদের নিয়োগকর্তাদের সামাজিক নিরাপত্তা অবদান থেকে অব্যাহতি দেবে। এই পদক্ষেপ ভারতীয় কর্মীদের জন্য যুক্তরাজ্যে কাজ করা আরও সাশ্রয়ী করবে।

কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে আলোচনা
প্রধানমন্ত্রী মোদী বৃহস্পতিবার লন্ডনের কাছে চেকার্সে, যা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি গ্রামীণ বাসভবন, কেয়ার স্টারমারের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করবেন। এই আলোচনা ভারত-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের সমস্ত দিক নিয়ে হবে, যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, শিক্ষা, জলবায়ু, স্বাস্থ্য এবং মানুষে-মানুষে সম্পর্ক। বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, এই সফর দুই দেশের ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বকে নতুন গতি প্রদান করবে।

২০২৩-২৪ সালে ভারত-যুক্তরাজ্য দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য ভারতের ষষ্ঠ বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ, যার মোট বিনিয়োগ ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, ভারতের প্রায় ১,০০০টি কোম্পানি যুক্তরাজ্যে কাজ করে, যারা প্রায় ১,০০,০০০ মানুষকে কর্মসংস্থান প্রদান করে এবং ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। এই চুক্তি এই সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে এবং প্রযুক্তি, গবেষণা এবং শিক্ষার মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াবে।

কিং চার্লস তৃতীয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ
প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর সফরের সময় ব্রিটিশ রাজা কিং চার্লস তৃতীয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। এটি তাঁর চতুর্থ যুক্তরাজ্য সফর, যা তিনি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে করছেন। এই সাক্ষাৎ দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে।

Advertisements

ভারতীয় প্রবাসীদের উৎসাহ
প্রধানমন্ত্রী মোদী লন্ডনে পৌঁছানোর পর ভারতীয় প্রবাসী সম্প্রদায় তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছে। লন্ডনের বাইরে সমবেত সম্প্রদায় নেতা, ছাত্র এবং সংসদ সদস্য10টি গ্রুপ এই চুক্তির জন্য উৎসাহ প্রকাশ করেছেন, যা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি (ওএফবিজেপি) সভাপতি কুলদীপ শেখাওয়াত বলেন, “এই চুক্তি উভয় সরকারের জন্য একটি বড় অর্জন, বিশেষ করে ভারতীয় প্রবাসীদের জন্য, যারা প্রধানমন্ত্রীকে এখানে দেখতে উৎসাহিত।”

প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পাশাপাশি, ভারত ও যুক্তরাজ্য প্রতিরক্ষা, গবেষণা এবং প্রযুক্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন গতি যোগ করতে চায়। গত বছর চূড়ান্ত হওয়া ভারত-যুক্তরাজ্য প্রযুক্তি নিরাপত্তা উদ্যোগ টেলিকম, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বায়োটেকনোলজি, সেমিকন্ডাক্টর এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়িয়েছে। এছাড়া, সাউথ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় গত সপ্তাহে গুরুগ্রামে একটি ক্যাম্পাস খোলার মাধ্যমে ভারতের নতুন শিক্ষানীতির অধীনে প্রথম বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগ শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে।

মালদ্বীপ সফর
লন্ডন থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী মালদ্বীপে যাবেন, যেখানে তিনি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজ্জুর আমন্ত্রণে দেশটির ৬০তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন। এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি কিছুটা টানাপোড়েনের পর সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতি এবং মাহাসাগর (মিউচুয়াল অ্যান্ড হোলিস্টিক অ্যাডভান্সমেন্ট ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রোথ অ্যাক্রস রিজিয়ন্স) দৃষ্টিভঙ্গির অধীনে মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা হবে।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সফর ভারত-যুক্তরাজ্য সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির স্বাক্ষর, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি সহযোগিতা এবং শিক্ষাগত উদ্যোগ দুই দেশের ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করবে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা এই চুক্তির মাধ্যমে নতুন বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাবেন, বিশেষ করে টেক্সটাইল এবং কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে। এই সফর শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতাই নয়, বরং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্পর্কের একটি নতুন ভিত্তি স্থাপন করবে।