ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী পীযূষ গয়াল শুক্রবার স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) যদি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (FTA) আলোচনায় পরিবেশ সংক্রান্ত কর বা বন উজাড় সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধের মতো অ-বাণিজ্যিক ইস্যুগুলিকে জোর করে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তাহলে ভারত কোনোভাবেই সেই চুক্তি সই করবে না।
দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নবম গ্লোবাল টেকনোলজি সামিটে কার্নেগি ইন্ডিয়া ও বিদেশ মন্ত্রকের যৌথ আয়োজনে গয়াল বলেন, “আমার মনে হয় আমরা বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে আলোচনার বেশিরভাগ অংশ সম্পন্ন করতে পারব।” তবে সেই সঙ্গে তিনি সতর্কবার্তাও দেন যে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইইউ-কে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের অ-বাণিজ্যিক এজেন্ডা যখন জোর করে বাণিজ্য আলোচনায় বসিয়ে দেয়, তখন তা গ্রহণযোগ্য নয়। যদি তারা এটি ছেড়ে না দেয়, তাহলে কারও পক্ষেই ইইউ-এর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করা সম্ভব নয়। কোনও আত্মমর্যাদাশীল দেশ এমন অযৌক্তিক ও বাণিজ্যের বাইরে থাকা দায়ভার স্বীকার করে নেবে না।”
তিনি আরও বলেন, “ভারত তো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান দায়ী নয়। যারা অতীতে শিল্পায়নের নামে পরিবেশ দূষণ করেছে, তাদের দায়ভার আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। বিশ্বের অন্য দেশগুলি যখন এই সমস্যার জন্য দায়ী, তখন ইউরোপ আমাদের ওপর দায় চাপিয়ে তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।”
EU-র অ-বাণিজ্যিক বাধা নিয়ে উদ্বেগ
পীযূষ গয়াল দ্বিতীয় যে ইস্যুটির কথা উল্লেখ করেন, তা হল ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর অ-বাণিজ্যিক বাধা বা ‘নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার’। তাঁর মতে, “আজ ইউরোপ নিজের তৈরি কঠোর বিধিনিষেধের জন্য সংকটে পড়েছে। আমেরিকা পর্যন্ত এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউরোপ যদি এই পথে চলতে থাকে, তাহলে তাদের পক্ষে অন্য কোনও দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালানো কঠিন হয়ে যাবে, ভারত তো দূরের কথা।”
মন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, “আমি ইউরোপের ভবিষ্যত নিয়ে সত্যিই চিন্তিত। ইউরোপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিও এই বিধিনিষেধে দিশেহারা। যদি তারা নিজেদের নীতিমালায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে ইউরোপ একদিন নিজেই একা হয়ে পড়বে। বিশ্ব তখন নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য চালিয়ে যাবে, ইউরোপ থাকবে সেই ব্যবস্থার বাইরে।”
চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ ইতিহাস
ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে। কিন্তু “ambition”-এর অভাব ও মতপার্থক্যের কারণে ২০১৩ সালে আলোচনা স্থগিত হয়। ২০২১ সালের মে মাসে ভারত-EU নেতাদের বৈঠকের পর ২০২২ সালের জুনে ফের আলোচনার সূচনা হয়। ইতিমধ্যেই নয় দফা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে এবং ইউরোপে নির্বাচনের পর ১০ম রাউন্ড শুরু হয়েছে। কিন্তু ইউরোপের অ-বাণিজ্যিক ইস্যু অন্তর্ভুক্তির অনড় অবস্থানের জন্য ১৮ বছরেও কোনও চুক্তিতে উপনীত হওয়া যায়নি।
ইউরোপের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংযোগ
গয়াল বলেন, “যখন আমি ইউরোপীয় মন্ত্রীদের সামনে ওখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলি, তখন অনেকেই বলেন আমি যেন ভারতের প্রতিনিধি নই, বরং তাদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছি। এটাই প্রমাণ করে যে, ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরাও এই কঠোর বিধিনিষেধে ক্ষতিগ্রস্ত। একপ্রকার একমত ভাবেই তারা এসব বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে।”
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রীর এই বক্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি একটি স্পষ্ট বার্তা যে, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বার্থে হতে পারে—পরিবেশ বা সামাজিক ইস্যু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। ভারতের মতে, এসব ইস্যুর জন্য যারা দায়ী, তাদেরই প্রথমে দায়িত্ব নেওয়া উচিত। ভারত তার আত্মমর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে কোনও অযৌক্তিক শর্ত মানতে রাজি নয়। ইউরোপের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা—যদি তারা বাস্তবতা না বোঝে, তবে ভবিষ্যতে বিশ্ব বাণিজ্যের মূল স্রোত থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।