ভারতের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহিলা উদ্যোক্তারা ক্রমশ একটি শক্তিশালী শক্তি হয়ে উঠছেন। তাদের উদ্যোক্তা মনোভাবকে উৎসাহিত করতে এবং ব্যবসায়িক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ভারত সরকার বিভিন্ন ঋণ প্রকল্প (Personal Loan for Women) চালু করেছে। এই প্রকল্পগুলো মহিলাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা বা সম্প্রসারণে সহায়তা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। ২০২৫ সালে মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য উপলব্ধ শীর্ষ সরকারি ঋণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্নপূর্ণা, মুদ্রা যোজনা, স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া, স্ত্রী শক্তি, সেন্ট কল্যাণী এবং উদ্যোগিনী। এই প্রতিবেদনে আমরা এই প্রকল্পগুলোর বিশদ বিবরণ এবং তাদের সুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করব, যাতে মহিলা উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
১. অন্নপূর্ণা প্রকল্প
অন্নপূর্ণা প্রকল্পটি বিশেষভাবে খাদ্য ও ক্যাটারিং ব্যবসায় নিয়োজিত মহিলাদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় মহিলা উদ্যোক্তারা ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন। এই ঋণের মাধ্যমে তারা রান্নাঘরের সরঞ্জাম, কাঁচামাল বা ফুড ট্রাক স্থাপনের মতো ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতে পারেন। ঋণটি ৩৬টি কিস্তিতে পরিশোধ করা যায় এবং এর জন্য জামানত এবং গ্যারান্টারের প্রয়োজন হয়। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঋণ প্রদান করে, এবং প্রথম মাসের কিস্তি মওকুফ করা হয়। সুদের হার বাজারের হারের উপর নির্ভর করে, যা সাধারণত অন্যান্য বাণিজ্যিক ঋণের তুলনায় কম। এই প্রকল্পটি বিশেষ করে গৃহভিত্তিক টিফিন সার্ভিস বা ছোট ক্যাটারিং ব্যবসা শুরু করতে চাওয়া মহিলাদের জন্য উপযুক্ত।
২. প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা (পিএমএমওয়াই)
প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা (পিএমএমওয়াই) মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য একটি জনপ্রিয় প্রকল্প, যা মাইক্রো এবং ছোট ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। এই প্রকল্পে তিনটি বিভাগ রয়েছে: শিশু (৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত), কিশোর (৫০,০০০ থেকে ৫ লাখ টাকা) এবং তারুণ (৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা)। ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না, যা এই প্রকল্পকে মহিলাদের জন্য আরও সহজলভ্য করে। সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম এবং পরিশোধের সময়কাল নমনীয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলারা বিউটি পার্লার, টিউশন সেন্টার, দর্জি দোকান বা হস্তশিল্পের মতো ব্যবসা শুরু বা সম্প্রসারণ করতে পারেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই প্রকল্পের আওতায় ৪.২৪ কোটি মহিলা উদ্যোক্তার জন্য ২.২২ লাখ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
৩. স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া
স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া প্রকল্পটি মহিলা এবং তফসিলি জাতি (এসসি) বা তফসিলি উপজাতি (এসটি) উদ্যোক্তাদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়, যা উৎপাদন, সেবা, বাণিজ্য বা কৃষি-সংশ্লিষ্ট খাতে নতুন উদ্যোগ স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা যায়। অ-ব্যক্তিগত উদ্যোগের ক্ষেত্রে, কমপক্ষে ৫১% শেয়ার মহিলা বা এসসি/এসটি উদ্যোক্তার মালিকানায় থাকতে হবে। ঋণের পরিশোধের সময়কাল ৭ বছর পর্যন্ত, এবং সর্বোচ্চ ১৮ মাসের মরাটোরিয়াম পিরিয়ড রয়েছে। এই প্রকল্পটি নতুন ব্যবসা শুরু করতে চাওয়া মহিলাদের জন্য একটি শক্তিশালী আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
৪. স্ত্রী শক্তি যোজনা
২০০০ সালে চালু হওয়া স্ত্রী শক্তি যোজনা মহিলা উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ টাকার বেশি ঋণের ক্ষেত্রে ০.৫% সুদের ছাড় দেওয়া হয়। মহিলাদের ব্যবসায় কমপক্ষে ৫০% মালিকানা থাকতে হবে এবং তাদের রাজ্য সংস্থার আয়োজিত উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রোগ্রামে (ইডিপি) অংশগ্রহণ করতে হবে। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না। এই প্রকল্পটি মহিলাদের সম্প্রদায়-কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে।
৫. সেন্ট কল্যাণী প্রকল্প
সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া দ্বারা পরিচালিত সেন্ট কল্যাণী প্রকল্প মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো জামানত বা গ্যারান্টার ছাড়াই ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করে। এই ঋণ কৃষি, খুচরা বা অন্যান্য ছোট ব্যবসায়ের জন্য ব্যবহার করা যায়। সুদের হার বাজারের হারের উপর নির্ভর করে এবং পরিশোধের সময়কাল ৭ বছর পর্যন্ত। এই প্রকল্পটি মহিলাদের জন্য ব্যবসা শুরু বা সম্প্রসারণের জন্য একটি সহজলভ্য বিকল্প।
৬. উদ্যোগিনী প্রকল্প
উদ্যোগিনী প্রকল্পটি বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মহিলাদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যাদের পরিবারের বার্ষিক আয় ১.৫ লাখ টাকার কম। এই প্রকল্পের আওতায় ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করা হয়, যা কৃষি, বাণিজ্য বা উৎপাদন খাতে ব্যবহার করা যায়। ঋণের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না এবং সুদের হারে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এই প্রকল্পটি গ্রামীণ এবং অনগ্রসর এলাকার মহিলাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে।
৭. মুখ্যমন্ত্রী মহিলা উৎকর্ষ যোজনা
গুজরাট সরকার কর্তৃক চালু মুখ্যমন্ত্রী মহিলা উৎকর্ষ যোজনা মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করে। এই ঋণের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না এবং পরিশোধের সময়কাল ৫ বছর। এছাড়াও, সময়মতো ঋণ পরিশোধকারীদের জন্য ৬% বার্ষিক ভর্তুকি দেওয়া হয়। এই প্রকল্পটি মহিলাদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং ব্যবসায়িক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামও প্রদান করে।
কেন এই প্রকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ?
এই ঋণ প্রকল্পগুলো মহিলা উদ্যোক্তাদের আর্থিক বাধা অতিক্রম করতে এবং তাদের ব্যবসায়িক স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করে। নিম্ন সুদের হার, জামানতমুক্ত ঋণ এবং নমনীয় পরিশোধের শর্তাবলী এই প্রকল্পগুলোকে আকর্ষণীয় করে তোলে। এছাড়াও, এই প্রকল্পগুলো মহিলাদের দক্ষতা উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করে, যা তাদের ব্যবসার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে। ২০২৫ সালে এই প্রকল্পগুলো মহিলাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতার দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ভারতের মহিলা উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অন্নপূর্ণা, মুদ্রা যোজনা, স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া, স্ত্রী শক্তি, সেন্ট কল্যাণী, উদ্যোগিনী এবং মুখ্যমন্ত্রী মহিলা উৎকর্ষ যোজনার মতো প্রকল্পগুলো তাদের আর্থিক সহায়তা এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করছে। মহিলা উদ্যোক্তারা এই প্রকল্পগুলোর সুবিধা গ্রহণ করে তাদের ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। তবে, আবেদনের আগে যোগ্যতার মানদণ্ড, ঋণের পরিমাণ, সুদের হার এবং পরিশোধের শর্তাবলী ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। এই প্রকল্পগুলো মহিলাদের জন্য শুধু আর্থিক সহায়তাই নয়, বরং একটি সমৃদ্ধ ও স্বাবলম্বী ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগও প্রদান করে।