করাচি স্টক এক্সচেঞ্জে ধস! ভারতের সিন্ধু চুক্তি বাতিলে ভেঙে পড়ল পাক-অর্থনীতি

Pakistan Stock Market: জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এই…

Pakistan Stock Market

Pakistan Stock Market: জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ জন পর্যটকের প্রাণ কেড়ে নেওয়া ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত, পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধের মতো কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার পর পাকিস্তানের স্টক এক্সচেঞ্জে (PSX) বড় ধরনের ধস নামে, যেখানে করাচি-১০০ সূচক (KSE-100) ২.১২% বা ২,৪৮৫.৮৫ পয়েন্ট পড়ে ১,১৪,৭৪০.২৯-এ নেমে আসে। বিকেল ৩:৩০ নাগাদ সূচকটি কিছুটা পুনরুদ্ধার করে ১,১৫,০১৪-এ উঠলেও তখনও ১.৮৯% নিম্নমুখী ছিল।

   

পহেলগাঁও হামলা ও ভারতের প্রতিক্রিয়া

২২ এপ্রিল, ২০২৫-এ পহেলগাঁওয়ের বাইসারান উপত্যকায় সন্ত্রাসীরা পর্যটকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়, যার ফলে ২৪ জন ভারতীয় এবং দুজন বিদেশি নাগরিক নিহত হন। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (TRF), যিনি সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের মতে, পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তৈয়বার একটি শাখা। ভারত সরকার হামলার পেছনে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে পাঁচটি কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি (CCS)-এর বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে:

• সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত: ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি, যা তিনটি যুদ্ধের (১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯) মধ্যেও অক্ষুণ্ণ ছিল, তা তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
• অটারি-ওয়াঘা সীমান্ত বন্ধ: পাঞ্জাবের এই গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত চেকপোস্ট বন্ধ করা হয়েছে। বৈধ অনুমোদন নিয়ে পারাপারকারীদের ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে ফিরতে হবে।
• SAARC ভিসা স্কিম বাতিল: পাকিস্তানি নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা ছাড় স্কিম বাতিল করা হয়েছে। ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে।
• কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস: নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা, নৌ এবং বিমান উপদেষ্টাদের ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভারতও ইসলামাবাদে নিজেদের সমমানের উপদেষ্টাদের প্রত্যাহার করছে।
• হাইকমিশনের কর্মী হ্রাস: উভয় দেশের হাইকমিশনের কর্মী সংখ্যা ৫৫ থেকে ৩০-এ নামিয়ে আনা হবে, যা ১ মে, ২০২৫-এর মধ্যে কার্যকর হবে।

পাকিস্তানের স্টক মার্কেটে ধস

ভারতের এই কঠোর পদক্ষেপের প্রভাব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে সরাসরি পড়েছে। করাচি স্টক এক্সচেঞ্জের KSE-100 সূচক বৃহস্পতিবার সকালে ২.১২% পতনের মুখ দেখে। যদিও দিনের শেষে এটি কিছুটা পুনরুদ্ধার করে ১.৮৯% কমে ১,১৫,০১৪-এ বন্ধ হয়। এই পতনের পেছনে ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণ এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা ছিল প্রধান কারণ। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে KSE-100 বিশ্বের অন্যতম সেরা পারফর্মিং সূচক ছিল, যা কম মূল্যায়ন এবং আকর্ষণীয় মূল্য-থেকে-আয় অনুপাতের কারণে প্রায় ৮০% বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে, ভারতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) কর্তৃক পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৩% থেকে ২.৬%-এ কমিয়ে দেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

সিন্ধু জল চুক্তির গুরুত্ব

১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত সিন্ধু জল চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জল ভাগাভাগির একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো। এই চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু, ঝিলাম এবং চেনাব নদীর জল প্রধানত পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ, যখন রাভি, বিয়াস এবং সতলজ নদী ভারতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তানের প্রায় ৮০% কৃষিজমি এই নদীগুলির উপর নির্ভরশীল, এবং করাচি, লাহোর, মুলতানের মতো শহরগুলি এই জলের উপর পানীয় ও পৌরসভার প্রয়োজন মেটায়।

Advertisements

সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার ভারতের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জ্বালানি উৎপাদনের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, ভারত বর্তমানে এই নদীগুলির জল প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ বা দিক পরিবর্তন করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবে ৫-১০% জল প্রবাহ কমাতে পারে। পাকিস্তানের বিদ্যুৎমন্ত্রী সরদার আওয়াইস লেঘারি এই সিদ্ধান্তকে “জল যুদ্ধ” বলে অভিহিত করে বলেছেন, এটি পাকিস্তানের জন্য গুরুতর পরিণতি বয়ে আনবে।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তান সরকার হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের নেতৃত্বে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (NSC) বৃহস্পতিবার একটি জরুরি বৈঠক করে। পাকিস্তানও প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য SAARC ভিসা স্কিম বাতিল করেছে (শিখ তীর্থযাত্রীদের ব্যতীত) এবং ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য তাদের আকাশপথ বন্ধ করেছে।

অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব

ভারতের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। সিন্ধু নদী ব্যবস্থা পাকিস্তানের জিডিপির প্রায় ২৫% অবদান রাখে, এবং এই জলের উপর নির্ভর করে তরবেলা এবং মাঙ্গলা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। জল প্রবাহ ব্যাহত হলে শিল্প, কৃষি এবং শহরগুলিতে পানি সংকট দেখা দিতে পারে, যা বেকারত্ব এবং গ্রামীণ অভিবাসন বাড়াতে পারে।

ভারতীয় শেয়ার বাজারে এই উত্তেজনার প্রভাব সীমিত ছিল। বৃহস্পতিবার BSE সেনসেক্স ২৫৯ পয়েন্ট (০.৩%) এবং নিফটি ৬৪ পয়েন্ট (০.২৬%) নিম্নমুখী ছিল। জিওজিত ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেসের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ ড. ভি.কে. বিজয়কুমার বলেন, ভারতীয় বাজারে জ্বালানি এবং অবকাঠামোর মতো ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকিপ্রবণ খাতে অস্থিরতা দেখা গেছে।

পহেলগাঁও হামলা ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে ফাটল ধরিয়েছে। ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতকরণ এবং অন্যান্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ পাকিস্তানের অর্থনীতি ও জনজীবনে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। পাকিস্তানের স্টক মার্কেটে ধস এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ আলোচনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা উভয় দেশের জন্য জরুরি।