জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল, ২০২৫) সংঘটিত ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় (Pahalgam Terror Attack) কমপক্ষে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। এই হামলা শুধুমাত্র নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং কাশ্মীরের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ পর্যটন শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এবং ট্রাভেল অ্যাগ্রিগেটররা বড়ো আকারে বুকিং বাতিলের আশঙ্কা করছেন। এই পরিস্থিতিতে এয়ারলাইন্স এবং হোটেলগুলির সঙ্গে আলোচনা করে বিনামূল্যে তারিখ পরিবর্তন এবং বুকিং বাতিলের সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পর্যটন শিল্পে তাৎক্ষণিক প্রভাব
পহেলগাঁওয়ের বৈসরন মেডোতে সংঘটিত এই হামলা কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের জন্য একটি বড়ো ধাক্কা। ক্লিয়ারট্রিপের চিফ গ্রোথ অ্যান্ড বিজনেস অফিসার মঞ্জরী সিংহল জানিয়েছেন, “প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ফ্লাইট বাতিলের সংখ্যা সাত গুণ বেড়েছে, এবং ভবিষ্যতের বুকিং ৪০ শতাংশ কমে গেছে।” এই হামলার পর পর্যটকদের মধ্যে ভয় এবং অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে অনেকেই তাদের কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করছেন। ট্রাভেল এজেন্টরা জানিয়েছেন, হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বাতিলের অনুরোধ বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ, হায়দ্রাবাদের একটি পরিবার হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে তাদের প্রিমিয়াম হলিডে প্যাকেজ বাতিল করেছে, যার মধ্যে পহেলগাঁওয়ে দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ট্রাভেল অ্যাগ্রিগেটর মেকমাইট্রিপের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা পহেলগাঁওয়ের এই মর্মান্তিক ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত। পর্যটকরা এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের দল এয়ারলাইন্স এবং হোটেল পার্টনারদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কাজ করছে যাতে বুকিং এবং বাতিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নমনীয়তা এবং সহায়তা প্রদান করা যায়।” ইজমাইট্রিপের চেয়ারম্যান এবং প্রতিষ্ঠাতা নিশান্ত পিট্টি বলেছেন, “শ্রীনগরের চলমান পরিস্থিতির কারণে, আমরা আমাদের গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২২ এপ্রিলের আগে করা সমস্ত বুকিংয়ের জন্য ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিনামূল্যে পরিবর্তন এবং বাতিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে।”
স্থানীয় জনজীবনের উপর প্রভাব
কাশ্মীরের অর্থনীতিতে পর্যটন একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে, যা জম্মু ও কাশ্মীরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৮.৪৭ শতাংশ অবদান রাখে। হোটেল মালিক, হাউসবোট মালিক, পনি চালক, গাইড, ড্রাইভার এবং কারিগরদের মতো স্থানীয় ব্যক্তিরা তাদের জীবিকার জন্য পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। এই হামলা তাদের জীবিকার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। ফেডারেশন অফ অ্যাসোসিয়েশনস ইন ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি (ফেথ)-এর জেনারেল সেক্রেটারি রাজীব মেহরা বলেছেন, “এই হামলা শুধু নিরীহ জীবন কেড়ে নেয়নি, বরং হাউসবোট মালিক, হোটেলিয়ার, স্থানীয় গাইড এবং কারিগরদের জীবিকাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্যুর অপারেটরস (আইএটিও) এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছে এবং বলেছে যে এটি কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পকে আঘাত করার জন্য এবং ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা হয়েছিল। পহেলগাঁও ট্যাক্সি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং পনি মালিকরা হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে তাদের জীবিকার উপর এই হামলার প্রভাব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এয়ারলাইন্সের উদ্যোগ
হামলার পর পর্যটকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য এয়ারলাইন্সগুলি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিগো ২৩ এপ্রিল শ্রীনগর থেকে দিল্লি এবং মুম্বাইয়ের জন্য চারটি অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত শ্রীনগর থেকে এবং শ্রীনগরের উদ্দেশে সমস্ত ফ্লাইটের জন্য বাতিল এবং পরিবর্তন ফি মওকুফ করেছে। তবে, ফ্লাইটের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে শ্রীনগর থেকে বাইরের টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে, যা পর্যটকদের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীনগর থেকে মুম্বাইয়ের ফ্লাইটের ভাড়া ২১,০০০ থেকে ২৩,০০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে।
পর্যটনের অতীত ও বর্তমান
কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। ২০২১ সালে ৬,৬৫,৭৭৭ পর্যটকের তুলনায় ২০২৪ সালে ৩৪,৯৮,৭০২ পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন, যা ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে। বিদেশী পর্যটকদের আগমনও ২০২১-এ ১,৬১৪ থেকে ২০২৪-এ ৪৩,৬৫৪-এ উন্নীত হয়েছে। সরকার ২০১৯ সালে আর্টিকেল ৩৭০ বাতিলের পর থেকে কাশ্মীরকে পর্যটন-বান্ধব গন্তব্য হিসেবে প্রচার করছিল। ২০২৩ সালে শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত জি২০ ট্যুরিজম ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা এই প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক ছিল। তবে, এই হামলা এই অগ্রগতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ও পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই হামলা স্বল্পমেয়াদে পর্যটন শিল্পের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। ইতিহাস বলে, এ ধরনের ঘটনার পর পর্যটন শিল্পে তাৎক্ষণিক পতন ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের শ্রীলঙ্কার ইস্টার বোমা হামলায় ৭০ শতাংশ পর্যটক হ্রাস পায় এবং পুনরুদ্ধারে ৯-১২ মাস সময় লাগে। তবে, দীর্ঘমেয়াদে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে, যদি সরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং কাশ্মীরকে নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে পুনঃব্র্যান্ডিং করে।
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলা কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের জন্য একটি মারাত্মক আঘাত। এটি শুধুমাত্র পর্যটকদের মধ্যে ভয় ছড়িয়েছে তা নয়, স্থানীয় অর্থনীতি এবং জনজীবনের উপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এয়ারলাইন্স এবং ট্রাভেল অ্যাগ্রিগেটররা পর্যটকদের সহায়তার জন্য পদক্ষেপ নিলেও, আর্থিক এবং লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ এখনও রয়ে গেছে। সরকার এবং স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। তবে, বর্তমানে শোক এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে, কাশ্মীরের মানুষ এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।