ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার (Pahalgam Attack) পর উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতিতে অস্ত্র কারখানাগুলি (Ordnance Factories) তাদের কর্মীদের দীর্ঘ ছুটি বাতিল করেছে, যাতে উৎপাদন ও প্রস্তুতি কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়। এই পদক্ষেপ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সামরিক প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে।
২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর এটি উপত্যকার সবচেয়ে মারাত্মক হামলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে, এবং গোলাবারুদ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে গোলাবারুদ কারখানাগুলিতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
জবলপুরের গোলাবারুদ কারখানায় দীর্ঘ ছুটি বাতিল
মধ্যপ্রদেশের জবলপুর জেলার খামারিয়া গোলাবারুদ কারখানা (ওএফকে)-তে কর্মকর্তা ও কর্মীদের দুই দিনের বেশি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এই পদক্ষেপের পেছনে মূল কারণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে। জবলপুরের এই কারখানাটি মিউনিশনস ইন্ডিয়া লিমিটেড (এমআইএল)-এর অন্যতম বৃহৎ ইউনিট, যেখানে প্রায় ৪,০০০ কর্মী কাজ করেন এবং এটি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গোলাবারুদ সরবরাহ করে।
ওএফকে-এর জনসংযোগ কর্মকর্তা অবিনাশ শঙ্কর সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে জানিয়েছেন, “এই অর্থবছরে আমাদের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বিশাল। এপ্রিল মাসে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। তাই পর্যাপ্ত কর্মী ও তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে সদর দফতরের নির্দেশে ছুটি বাতিল করা হয়েছে।”
এই পদক্ষেপ জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বলে মনে করা হচ্ছে, যদিও কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা মিস হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। পহেলগাঁও হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেনাবাহিনীর চাহিদা মেটাতে গোলাবারুদ উৎপাদন ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
মহারাষ্ট্রের গোলাবারুদ কারখানায়ও ছুটি বাতিল
জবলপুরের পদক্ষেপের পর মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর জেলার গোলাবারুদ কারখানায়ও একই ধরনের নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এখানে সমস্ত কর্মীদের ছুটি তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হয়েছে এবং তাদের যত দ্রুত সম্ভব কর্মস্থলে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মিউনিশনস ইন্ডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশ অনুসারে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চন্দ্রপুর গোলাবারুদ কারখানার প্রধান সাধারণ ব্যবস্থাপকের একটি আদেশে বলা হয়েছে, “জাতীয় নিরাপত্তা ও অপারেশনাল জরুরি অবস্থার স্বার্থে সমস্ত ধরনের ছুটি (অর্জিত ছুটি, নৈমিত্তিক ছুটি এবং অন্যান্য অনুমোদিত ছুটি) তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হল। সমস্ত কর্মীদের অবিলম্বে কর্মস্থলে ফিরে এসে নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি ও অবদান নিশ্চিত করতে হবে। এই নির্দেশের কঠোরভাবে পালন করা বাধ্যতামূলক। শুধুমাত্র অত্যন্ত জরুরি পরিস্থিতিতে এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা বা প্রধান সাধারণ ব্যবস্থাপকের বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে ছুটির জন্য ছাড় দেওয়া হবে।”
এই আদেশে স্পষ্টভাবে জাতীয় নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্বকে নির্দেশ করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং সীমান্তে অব্যাহত সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে এই পদক্ষেপকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: সীমান্তে অব্যাহত উত্তেজনা
পহেলগাঁও হামলার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তানি সেনারা জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি) বরাবর বিভিন্ন সেক্টরে অব্যাহতভাবে অযাচিত গুলি চালাচ্ছে। শনিবার ও রবিবারের মধ্যবর্তী রাতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পাঁচটি জেলায় ছড়িয়ে থাকা আটটি স্থানে গুলি চালানো হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী এর কার্যকর জবাব দিয়েছে, তবে এখনও কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
২৪ এপ্রিল রাত থেকে পাকিস্তানি সেনারা এলওসি বরাবর অযাচিত গুলি চালাচ্ছে। এই ঘটনা শুরু হয় পহেলগাঁও হামলার পর ভারত কর্তৃক ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি স্থগিত করার কয়েক ঘণ্টা পর। গত ১০ দিন ধরে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অব্যাহত গুলি চালানো হচ্ছে, যা পহেলগাঁও হামলার পর উত্তেজনার প্রতিফলন।
গোলাবারুদ কারখানার গুরুত্ব
মিউনিশনস ইন্ডিয়া লিমিটেড (এমআইএল) ভারতের ১২টি গোলাবারুদ কারখানার সমন্বয়ে গঠিত একটি সংস্থা, যা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর জন্য গোলাবারুদ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। জবলপুরের খামারিয়া গোলাবারুদ কারখানা এবং চন্দ্রপুরের গোলাবারুদ কারখানা এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। এই কারখানাগুলি শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে না, বরং বিশ্বব্যাপী রপ্তানি আদেশও পূরণ করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কারখানাগুলির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে উত্তেজনা এবং সম্ভাব্য সামরিক পদক্ষেপের প্রেক্ষাপটে গোলাবারুদের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই কর্মীদের ছুটি বাতিল করে উৎপাদন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি প্রতিশ্রুতি
পহেলগাঁও হামলার পর ভারত সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উচ্চ-পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীকে সম্পূর্ণ অপারেশনাল স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। এছাড়াও, ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য, জাহাজ চলাচল এবং ডাক পরিষেবা বন্ধ করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
গোলাবারুদ কারখানাগুলির ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি ভারতের অটল প্রতিশ্রুতির একটি অংশ। এই পদক্ষেপগুলি ভারতের সামরিক প্রস্তুতি এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়।
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নজিরবিহীন উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অস্ত্র কারখানাগুলি তাদের কর্মীদের ছুটি বাতিল করে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে উৎপাদন ত্বরান্বিত করছে। জবলপুর এবং চন্দ্রপুরের গোলাবারুদ কারখানাগুলির এই পদক্ষেপ ভারতের সামরিক প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সীমান্তে পাকিস্তানের অব্যাহত উসকানি এবং হামলার প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপগুলি ভারতের দৃঢ় অবস্থানকে তুলে ধরে। তবে, এই উত্তেজনা কীভাবে বিবর্তিত হয় এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হবে, তা ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করছে।