ট্রাম্পের নতুন আইন, ভারতে টাকা পাঠাতে NRIs এখন চিন্তায়

যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ‘ওয়ান বিগ, বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ (One Big-Beautiful Bill Act) অবশেষে আইনে পরিণত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমর্থনে এই বিলটি ৪ জুলাই…

NRI Remittance Tax, One Big Beautiful Bill,US Senate, Donald Trump

যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ‘ওয়ান বিগ, বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ (One Big-Beautiful Bill Act) অবশেষে আইনে পরিণত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমর্থনে এই বিলটি ৪ জুলাই স্বাধীনতা দিবসের দিন হোয়াইট হাউজে একটি অনুষ্ঠানে সই হয়। এই আইনে বড় ধরনের কর সংস্কার, সামাজিক কল্যাণ খাতে কাটছাঁট, প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।

তবে এই বিলের সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো রেমিট্যান্স ট্যাক্স আরোপের প্রস্তাব, যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় অভিবাসীদের উপর প্রভাব ফেলবে। নতুন আইন অনুযায়ী, এখন থেকে যারা H1B, L1, F1 ভিসায় বা গ্রিন কার্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, তাদের ভারতসহ অন্যান্য দেশে টাকা পাঠানোর সময় ৩.৫% হারে এক্সসাইজ ট্যাক্স দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে এই হার ৫% প্রস্তাব করা হয়েছিল, পরে তা কমিয়ে ৩.৫% করা হয়েছে।

   

ভারতীয় অভিবাসীদের অর্থনৈতিক চাপ:
ASA & ASSOCIATES LLP-এর ট্যাক্স পার্টনার বিক্রমজিৎ বেদী জানান, “এই নতুন ট্যাক্সের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয়রা যারা নিয়মিতভাবে পরিবারের জন্য অর্থ পাঠান, তাদের উপর তাৎক্ষণিক আর্থিক চাপ তৈরি হবে। অনেকেই হয়তো নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।”

রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ২৮%। এই ট্যাক্সের কারণে যদি রেমিট্যান্সের পরিমাণ হ্রাস পায়, তাহলে ভারতের গ্রামীণ ও শহুরে অর্থনীতিতে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। পরিবারের আয়ের একটি বড় অংশ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফলে ভোগব্যয়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ডাবল ট্যাক্সেশন এভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট (DTAA) নিয়ে আইনি জটিলতা:
নতুন ট্যাক্স প্রস্তাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের ডাবল ট্যাক্সেশন এভয়ডেন্স এগ্রিমেন্ট (DTAA) নিয়ে আইনি বিতর্ক। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই রেমিট্যান্স ট্যাক্স DTAA-এর নন-ডিসক্রিমিনেশন ধারা লঙ্ঘন করছে। অন্যদিকে, অনেকে বলছেন, এই ধারা কেবল আয়কর সম্পর্কিত, এক্সসাইজ বা লেনদেন ভিত্তিক কর নয়। ফলে আইনি লড়াই এবং ব্যাখ্যার দরজা খোলা থাকছে।

ট্যাক্স ক্রেডিট নিয়ে অনিশ্চয়তা:
বেদী আরও জানান, “ভারতে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে TCS (Tax Collected at Source) এর মতো ব্যবস্থা রয়েছে এবং এখানে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে ছাড় পাওয়া যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই ট্যাক্সে কোনো ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।” এর ফলে প্রবাসীদের আর্থিক হিসাব-নিকাশে জটিলতা বাড়বে এবং ট্যাক্স ক্রেডিট পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে।

Advertisements

নতুন প্রশাসনিক ঝামেলা:
BDO ইন্ডিয়ার গ্লোবাল এমপ্লয়ার সার্ভিসেসের পার্টনার দীপাশ্রী শেঠি জানান, “এই ট্যাক্সের ফলে শুধু আর্থিক বোঝা নয়, প্রশাসনিক ঝামেলাও অনেক বাড়বে। রেমিটারদের ব্যাংকের কাছে আরও বেশি তথ্য দিতে হবে, যেমন নাগরিকত্ব, রেমিট্যান্সের পরিমাণ, কত ট্যাক্স দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি।”

তিনি আরও বলেন, “H1B, L1, F1 ভিসাধারী এবং অস্থায়ী বাসিন্দারা সাধারণত রেমিট্যান্সের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করেন। এই অতিরিক্ত চার্জের ফলে প্রেরিত অর্থের পরিমাণ কমে যাবে, যা পরিবারগুলোর জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে।”

প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ ও শঙ্কা:
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বহু ভারতীয় এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ ও হতাশ। তাদের বক্তব্য, পরিবারের জন্য পাঠানো অর্থে কর বসানো মানবিকভাবে অযৌক্তিক। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে বসবাসরত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রাহুল চক্রবর্তী বলেন, “আমরা দেশের মঙ্গল ও পরিবারের কল্যাণের জন্যই অর্থ পাঠাই। এখন এই ট্যাক্সের কারণে হয়তো কম অর্থ পাঠাতে বাধ্য হব। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের সাধারণ মানুষ।”

ভারতের রেমিট্যান্স নির্ভরতা:
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশ হলো ভারত। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ভারত প্রায় ১১৮.৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। এর একটি বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বড় উৎস এবং পরিবারভিত্তিক খরচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই নতুন ট্যাক্সের ফলে রেমিট্যান্স কমে গেলে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
মোট কথা, ট্রাম্পের ‘ওয়ান বিগ, বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ মার্কিন অভিবাসীদের মধ্যে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বিশেষ করে ভারতীয় প্রবাসীদের জন্য এটি একটি বড় আর্থিক ও মানসিক ধাক্কা। অনেকের মতে, এই আইনের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতে আইনি চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে এই ট্যাক্স কার্যকর হওয়ায় অভিবাসীদের জীবনে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলাফল কতটা গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদি হবে, তা সময়ই বলবে।