বিশ্ববাজারে শুক্রবার তেলের দাম হ্রাস (Oil Prices Drop) পেয়েছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে, যা ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘর্ষে তার ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। শুক্রবার সকাল ১১টা ৮ মিনিটে, লন্ডনের ইন্টারকন্টিনেন্টাল এক্সচেঞ্জে ব্রেন্ট অগাস্ট চুক্তির দাম দাঁড়ায় প্রতি ব্যারেল $৭৭.২০, যা আগের দিনের তুলনায় ২% কম। এই হ্রাস মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিবৃতির পরে ঘটেছে, যা বাজারে অনিশ্চয়তা কিছুটা কমিয়েছে।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “ইরানের সঙ্গে ভবিষ্যতে আলোচনা হওয়ার একটি বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে—তা হতে পারে বা নাও হতে পারে—এই বিবেচনায় আমি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব, আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) গিয়ে হস্তক্ষেপ করব কি না।”
বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরণের ‘দুই সপ্তাহের সময়সীমা’ অতীতেও ট্রাম্প প্রশাসন কৌশলগত চাপ তৈরির জন্য ব্যবহার করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়সীমাগুলি পার হলেও বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে এই ধরনের অনিশ্চয়তা বাজারে উত্তেজনা তৈরি করে, যার প্রভাবে অপরিশোধিত তেলের দাম স্বাভাবিকভাবে কিছুটা উঁচু অবস্থানে থাকে।
ইরানের সতর্কবার্তা এবং উৎপাদনচিত্র:
এই পরিস্থিতির মাঝেই ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়েছে, যেকোনো ধরনের মার্কিন হস্তক্ষেপ ওয়েস্ট এশিয়ায় আরও উত্তেজনা সৃষ্টি করবে, যা এই অঞ্চল থেকে বৈশ্বিক তেল সরবরাহে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটাতে পারে।
ইরান হলো ওপেক (OPEC) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক দেশ। বর্তমানে দেশটি প্রতিদিন গড়ে ৩.৩ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করছে। বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, ইরান স্যাংশন থাকা সত্ত্বেও প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২.২ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি করছে।
বিশ্লেষকদের মতামত: অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনা:
মেহতা ইকুইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল কালান্তরি বলেন, “ইসরায়েল-ইরান সংঘাত সংক্রান্ত যে কোনো বিবৃতি ও রাজনৈতিক অবস্থানের ফলে অপরিশোধিত তেলের দামে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। গতকাল হঠাৎ করেই দাম বেড়ে গিয়েছিল, তবে আজ সকালে হোয়াইট হাউসের বিবৃতি বাজারে স্বস্তি এনে দিয়েছে এবং দাম কিছুটা কমেছে।”
তবে তিনি এটাও জানান যে, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে এখনও অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তির দিকেই রয়েছে এবং এটি টানা তৃতীয় সপ্তাহের জন্য মূল্য বৃদ্ধির পথে।
সরবরাহ বিঘ্নের আশঙ্কা বহাল:
কালান্তরি আরও বলেন, “বাজারে এখনো ভয় রয়েছে যে, ইরান থেকে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে। এই জিওপলিটিকাল উত্তেজনা ও সরবরাহ সংকটের আশঙ্কাই মূলত তেলের দামে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।”
রিলায়েন্স সিকিউরিটিজের সিনিয়র রিসার্চ অ্যানালিস্ট শ্রীরাম আয়্যরও এই মতের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলেন, “ওয়েস্ট এশিয়ার উত্তেজনা যদি আরও বাড়ে, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ করে অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। এটি এখন একটি বড় উদ্বেগের কারণ।”
ভারতের প্রভাব: আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে:
ভারত, যেহেতু বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ, তাই এই ঘটনাগুলির প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বুধবার পর্যন্ত ভারতের ক্রুড অয়েল বাস্কেটের গড় দাম ছিল ৭৫.৯১ ডলার প্রতি ব্যারেল। জুন মাসের গড় মূল্য দাঁড়িয়েছে ৬৮.৫৮ ডলার প্রতি ব্যারেল, যা মে মাসের ৬৪.০৪ ডলার থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
এই দাম বৃদ্ধির ফলে ভারতীয় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও পরিবহন খরচে এবং সম্ভাব্যভাবে সাধারণ ভোক্তা মূল্যস্ফীতিতেও।
বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের আশঙ্কা বিশ্ব তেল বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। যদিও সাময়িকভাবে মূল্য কমেছে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অনিশ্চয়তা এবং সরবরাহ বিঘ্নের সম্ভাবনা তেলের দামে একটি শক্তিশালী সমর্থনের ভূমিকা পালন করবে। ভারত সহ অন্যান্য আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত—যেখানে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে সামান্য পরিবর্তনও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
তেল বাজারে আগামী সপ্তাহগুলোতে নজর থাকবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এবং ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের অগ্রগতির দিকে।