Mumbai, 10 October: ভারতের সরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক নীতি আয়োগ এবার কর সংস্কারের নতুন পথের দিশা দেখাল। শুক্রবার প্রকাশিত একটি কর্মপত্রে তারা আস্থাভিত্তিক কর শাসন বা Trust-Based Taxation মডেল চালুর প্রস্তাব দিয়েছে। এই মডেলের মূল লক্ষ্য হল করদাতাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, প্রশাসনিক জটিলতা হ্রাস করা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তোলা।
প্রতিবেদনটির নাম— “Towards India’s Tax Transformation: Decriminalisation and Tax-Based Governance”। এতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ভারতের কর শাসন ব্যবস্থাকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক করতে হলে শাস্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আস্থা ও সহযোগিতাভিত্তিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
বর্তমানে কর ব্যবস্থা অনেকটাই পুরোনো ধাঁচের। কর আদায়ের ক্ষেত্রে এখনো জরিমানা, অডিট এবং কঠোর তদন্তের মতো প্রক্রিয়াই প্রাধান্য পায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এতে কর ফাঁকি পুরোপুরি রোধ করা যায় না। জটিল নিয়ম, প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা এবং করদাতা ও কর কর্তৃপক্ষের মধ্যে আস্থার অভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। নীতি আয়োগ বলেছে, এই জায়গাতেই পরিবর্তন দরকার।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো— বিশেষ করে OECD-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো— ইতিমধ্যেই ‘Co-operative Compliance’ বা সহযোগিতাভিত্তিক কর প্রোগ্রাম চালু করেছে। এর ফলে কর ফাঁকি কমেছে, কর্পোরেট স্বচ্ছতা বেড়েছে এবং করদাতারা কর প্রদানে আরও আগ্রহী হয়েছেন। ভারতের ক্ষেত্রেও সেই ধরনের একটি কাঠামো গড়ে তোলা দরকার বলে মনে করছে নীতি আয়োগ।
ডিজিটাল প্রক্রিয়ার গুরুত্ব
ভারতে ইতিমধ্যেই কর সংস্কারের ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফেসলেস অ্যাসেসমেন্ট স্কিম, ট্যাক্সপেয়ার চার্টার ইত্যাদি উদ্যোগ কর ব্যবস্থাকে অনেকটাই স্বচ্ছ ও ঝামেলামুক্ত করেছে। নীতি আয়োগ জানিয়েছে, এই উদ্যোগগুলির ওপর ভিত্তি করে আরও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করলে করদাতারা সহজেই তথ্য পাবেন, রিয়েল-টাইমে কর সংক্রান্ত তথ্য আপডেট করতে পারবেন এবং ফাইলিং প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে। এর ফলে দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপও অনেকটা কমবে।
তবে সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, কেবল প্রযুক্তি দিয়ে আস্থা তৈরি করা সম্ভব নয়। কর প্রশাসনের আচরণ যদি ন্যায্য না হয়, অভিযোগ নিষ্পত্তি যদি দেরি হয়, বা করদাতাদের তথ্য গোপনীয়তা রক্ষা না করা হয়— তাহলে আস্থাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা সফল হবে না। সরকারকে নাগরিকদের করের অর্থ স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ মনে করেন তারা কর দিয়ে যে অর্থ দিচ্ছেন, তার যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন।
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কর কর্মকর্তাদের কেবল আইন প্রয়োগ নয়, বরং ডেটা বিশ্লেষণ, সহানুভূতিশীল যোগাযোগ এবং ন্যায্যভাবে বিরোধ নিষ্পত্তিতে দক্ষ হতে হবে। এতে করদাতা ও প্রশাসনের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে আস্থা তৈরি হবে। এই পরিবর্তন ঘটলে কর ফাঁকি কমবে, একইসাথে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন নানা আর্থিক ধাক্কা থেকে পুনরুদ্ধার করছে, তখন ভারতের জন্য এই ধরনের মডেল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আস্থাভিত্তিক কর শাসন কাঠামো শুধু রাজস্ব আদায় বাড়াবে না, বরং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াবে।
সব মিলিয়ে, নীতি আয়োগের এই প্রস্তাব ভারতের কর সংস্কারের ক্ষেত্রে এক বড় পদক্ষেপ হতে পারে। যদি সরকার এটিকে বাস্তবায়ন করে, তাহলে দেশের কর ব্যবস্থায় শাস্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গায় স্বচ্ছতা, সহযোগিতা এবং আস্থা জায়গা করে নেবে। আর সেই আস্থা দীর্ঘমেয়াদে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।