পশ্চিম সীমান্তে (Indo-Pak Tensions) ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন শুক্রবার (৯ মে ২০২৫) পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের ব্যাঙ্ক, বীমা সংস্থা এবং গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চলমান উত্তেজনার মধ্যে আর্থিক খাতের প্রস্তুতি এবং সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুসারে, বৈঠকে আর্থিক সেক্টরের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা এবং ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং ও ইউপিআই-এর মতো ডিজিটাল আর্থিক পরিষেবাগুলির নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা নিশ্চিত করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক পরিষেবা বিভাগ, ভারতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (সিইআরটি-ইন), রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই), বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আইআরডিএআই) এবং ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এনপিসিআই)-এর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের প্রেক্ষাপটে গত ২২ এপ্রিল পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের ‘অপারেশন সিন্দুর’ এবং পাকিস্তানের পাল্টা ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ উল্লেখযোগ্য, যা দুই দেশের মধ্যে সামরিক উত্তেজনাকে চরমে তুলেছে।
ব্যাঙ্কগুলির সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার
ব্যাঙ্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, তারা সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ মাপের সাইবার হামলা প্রতিরোধে উন্নত অ্যান্টি-ডিডিওএস (ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়াল-অফ-সার্ভিস) সিস্টেম স্থাপন। ব্যাঙ্ক কর্মকর্তারা জানান, সাইবার লঙ্ঘন এবং দুর্যোগ পুনরুদ্ধারের পরিস্থিতি নিয়ে সর্বোচ্চ স্তরে মক ড্রিল পরিচালিত হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি নিশ্চিত করছে। ফিশিং প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বর্ধিত সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে, এবং কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে একাধিক অভ্যন্তরীণ সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
ব্যাঙ্কগুলির সিকিউরিটি অপারেশন সেন্টার (এসওসি) এবং নেটওয়ার্ক অপারেশন সেন্টার (এনওসি) সম্পূর্ণ সক্রিয় এবং উচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলি সিইআরটি-ইন এবং ন্যাশনাল ক্রিটিকাল ইনফরমেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোটেকশন সেন্টার (এনসিআইআইপিসি)-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে রিয়েল-টাইম ডেটা শেয়ারিং এবং হুমকি বিশ্লেষণ করছে। এই সমন্বিত পদ্ধতি সম্ভাব্য সাইবার হুমকি দ্রুত সনাক্ত ও প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
নিরবচ্ছিন্ন পরিষেবা নিশ্চিত করার নির্দেশ
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে আর্থিক খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উপর জোর দিয়ে সীতারামন ব্যাঙ্কগুলিকে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলিতে। তিনি এটিএম-এ নিরবচ্ছিন্ন নগদ সরবরাহ, ইউপিআই এবং ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং পরিষেবার ধারাবাহিকতা এবং মূল ব্যাঙ্কিং ফাংশনের অব্যাহত প্রাপ্যতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের জরুরি প্রোটোকল আপডেট করতে এবং কঠোরভাবে পরীক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ডিজিটাল এবং মূল ব্যাঙ্কিং অবকাঠামো সম্পূর্ণ ফায়ারওয়ালড এবং সার্বক্ষণিক নিরীক্ষণে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে কোনো ধরনের সাইবার লঙ্ঘন বা শত্রুতামূলক কার্যকলাপ রোধ করা যায়। প্রতিটি ব্যাঙ্ককে তাদের সদর দফতরে দুজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিয়োগ করতে বলা হয়েছে—একজন সাইবার-সম্পর্কিত বিষয়গুলি পরিচালনার জন্য এবং অন্যজন এটিএম-এ নগদ প্রাপ্যতা এবং শাখাগুলির কার্যকারিতাসহ অপারেশনাল বিষয়গুলি তদারকির জন্য। এই কর্মকর্তাদের সিইআরটি-ইন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিতে রিয়েল-টাইম ভিত্তিতে যেকোনো ঘটনা রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরআরবি এবং গ্রাহক পরিষেবার জন্য সমর্থন
সীতারামন ব্যাঙ্কগুলিকে আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলিকে (আরআরবি) অতিরিক্ত সমর্থন প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে চলমান উত্তেজনার মধ্যে তারা মসৃণভাবে কাজ করতে পারে। বীমা সংস্থাগুলিকে দ্রুত দাবি নিষ্পত্তি এবং গ্রাহক পরিষেবার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাতে পলিসিধারীদের কোনো অসুবিধা না হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি
সীতারামন জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি সরকারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দেশের আর্থিক অবকাঠামো শক্তিশালী এবং স্থিতিস্থাপক রয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আর্থিক খাতের সুরক্ষা বৃহত্তর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জনগণের আস্থা বজায় রাখার জন্য অপরিহার্য।
সংঘাতের প্রেক্ষাপট
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা গত ২২ এপ্রিল পাহালগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে তীব্র হয়েছে, যেখানে ২৬ জন, বেশিরভাগই পর্যটক, নিহত হয়েছিলেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জৈশ-ই-মোহাম্মদকে দায়ী করেছে। এর জবাবে ৭ মে ভারত ‘অপারেশন সিন্দুর’ পরিচালনা করে, যেখানে পাকিস্তান ও পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে (পিওকে) নয়টি সন্ত্রাসী ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। পাকিস্তান এই হামলাকে “যুদ্ধের কাজ” হিসেবে অভিহিত করে ‘অপারেশন বানিয়ান মারসুস’ শুরু করে, যার অধীনে তারা ভারতের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে।
শুক্রবার রাতে কাশ্মীর উপত্যকায় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে, যখন সন্দেহভাজন পাকিস্তানি ড্রোন ভারতীয় আকাশসীমায় প্রবেশ করে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ২৬টি স্থানে সশস্ত্র ড্রোন দেখা গেছে, যা বেসামরিক ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার চেষ্টা করেছিল। এই পরিস্থিতিতে ভারতের ৩২টি বিমানবন্দরে বেসামরিক ফ্লাইট বন্ধ করা হয়েছে, এবং পাকিস্তান তাদের আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে।
সাইবার হুমকির প্রেক্ষাপট
সাম্প্রতিক দিনগুলিতে পাকিস্তান-সমর্থিত হ্যাকাররা ভারতের প্রতিরক্ষা ওয়েবসাইটগুলিকে লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে। এই সাইবার হুমকির প্রেক্ষাপটে আর্থিক খাতের সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ব্যাঙ্ক কর্মকর্তারা সীতারামনকে আশ্বস্ত করেছেন যে তারা অ্যান্টি-ডিডিওএস সিস্টেম এবং রিয়েল-টাইম হুমকি নিরীক্ষণের মাধ্যমে যেকোনো সাইবার হামলা প্রতিরোধে প্রস্তুত।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শন এবং সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার আহ্বান জানিয়েছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে, ভারত দ্বিপাক্ষিক সমস্যায় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছে, শিমলা চুক্তি এবং লাহোর ঘোষণার উপর জোর দিয়ে।
নির্মলা সীতারামনের এই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার মধ্যে আর্থিক খাতের প্রস্তুতি এবং স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সাইবার নিরাপত্তা জোরদার, নিরবচ্ছিন্ন ব্যাঙ্কিং পরিষেবা এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় কর্মীদের নিরাপত্তার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের আর্থিক অবকাঠামো শক্তিশালী থাকলেও, সাইবার হুমকি এবং সামরিক সংঘাতের প্রেক্ষাপটে সতর্কতা এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সংকটকালে জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকার এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।