কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন (Nirmala Sitharaman) শনিবার এক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যে জানিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনা ভালোভাবেই এগোচ্ছে। এ মন্তব্য তিনি করেন এমন এক সময়ে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে আগামী ১ আগস্ট থেকে দেশভিত্তিক শুল্ক নীতি কার্যকর হতে চলেছে।
অর্থমন্ত্রী এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, “আমি মন্তব্য করব না দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভালো না খারাপ, তবে এটুকু বলতে পারি — আমরা এগোচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের আলোচনাগুলি ভালোভাবেই অগ্রসর হচ্ছে।” সংবাদ সংস্থাগুলির প্রতিবেদনে এই বক্তব্য উঠে এসেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোষণা:
এর আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, তাঁর প্রশাসন বিশ্বের প্রায় ২০০টির বেশি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করবে এবং ১ আগস্টের মধ্যে অধিকাংশ চুক্তি সম্পন্ন হবে। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, “যখন চিঠিগুলি যাবে… মাত্র দেড় পৃষ্ঠার… তখন বোঝা যাবে চুক্তি সম্পূর্ণ হয়েছে। তারা সেই শুল্ক দেবে, সেটাই মূলত চুক্তি।”
এই পদক্ষেপে ভারতের মতো দেশগুলোর উপরও প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকায় দেশটির সঙ্গে আলোচনাকে ভারত অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA): ঐতিহাসিক ‘উইন-উইন’ চুক্তি:
এই সপ্তাহেই ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) সই হয়েছে। বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল একে ‘গেম-চেঞ্জার’ বা খেলা বদলে দেওয়া চুক্তি হিসেবে আখ্যা দেন।
মন্ত্রী বলেন, “এই চুক্তি কৃষক, ব্যবসায়ী, MSME (মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ), তরুণ পেশাজীবী এবং জেলেদের জন্য বিশাল সুযোগ ও সুবিধা তৈরি করবে।” তিনি আরও জানান, “ভারতীয় মন্ত্রিসভা ইতিমধ্যে এই চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং যুক্তরাজ্যের সংসদে অনুমোদনের পর তা কার্যকর হবে।”
CETA: ভারত-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম চুক্তি:
এই চুক্তির আনুষ্ঠানিক নাম হলো Comprehensive Economic and Trade Agreement (CETA)। এটি এমন একটি সমঝোতা যেখানে ভারতের ৯৯ শতাংশ রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাজ্যে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। অর্থাৎ প্রায় পুরো রপ্তানি পণ্যতালিকাই এই সুবিধার আওতায় পড়বে।
পীযূষ গোয়েল বলেন, “যতগুলো FTA ভারত এ যাবত সই করেছে, তার মধ্যে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি সবচেয়ে বড়, সর্বাধিক বিস্তৃত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি উল্লেখ করেন, প্রায় ২২-২৩ বছর আলোচনার পর এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলো।
FTA-র মূল সুবিধাগুলি:
শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার: ভারতীয় রপ্তানির ৯৯ শতাংশ পণ্য যুক্তরাজ্যে শুল্ক ছাড়াই প্রবেশ করতে পারবে। এতে বিশেষভাবে উপকৃত হবে বস্ত্র, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্য, মৎস্যজাত পণ্য ও ফার্মাসিউটিক্যালস খাত।
MSME খাতের উন্নয়ন: ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির জন্য যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
তরুণ পেশাজীবীদের জন্য সুযোগ: চুক্তির আওতায় উভয় দেশের পেশাজীবীদের চলাচল সহজতর হবে। ভিসা নীতিতেও নমনীয়তা আনা হতে পারে।
বিনিয়োগে উন্নতি: FTA উভয় দেশের মধ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ খুলে দেবে, বিশেষত প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং পরিষেবা খাতে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিতে ভারতের অগ্রগতি:
এফটিএ স্বাক্ষরের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলির সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন দিক নিচ্ছে। একদিকে মার্কিন শুল্কনীতি পরিবর্তন, অন্যদিকে ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের এই সময়টি ভারতের জন্য কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নির্মলা সীতারামন ও পীযূষ গোয়েলের যৌথ বার্তায় স্পষ্ট— ভারত এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যে আরও সক্রিয় ও কৌশলী ভূমিকা নিচ্ছে। বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল পুনর্গঠনের এই সময়ে ভারত তার অবস্থানকে মজবুত করতে চায় এবং এই ধরনের FTA-ই সেই প্রচেষ্টার অংশ।
ভারত-যুক্তরাজ্য FTA শুধুমাত্র একটি চুক্তি নয়, এটি একটি নতুন দিকচিহ্ন যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও গভীর এবং বিস্তৃত করবে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি এবং ইউরোপের সঙ্গে চালু থাকা আলোচনাগুলি প্রমাণ করে, ভারত এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের অবস্থান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত।
এই চুক্তিগুলির বাস্তবায়ন হলে দেশের কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক ও পেশাজীবীরা সরাসরি উপকৃত হবেন এবং দেশের অর্থনীতিও পাবে নতুন গতি।