ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি সংসদে একটি নতুন খসড়া আইন পেশ করেছে, যা বিদেশি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশ, অবস্থান এবং প্রস্থান সংক্রান্ত বিভিন্ন পরিষেবাকে সহজতর করার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই নতুন আইনটি “ইমিগ্রেশন এবং ফরেইনারস বিল, ২০২৫” নামে পরিচিত।
এই বিলটি বর্তমানে সংসদের লোকসভায় পেশ করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে ২০০০ সালের “ইমিগ্রেশন (ক্যারিয়ারস’ লায়াবিলিটি) অ্যাক্ট” এবং স্বাধীনতার আগে প্রণীত তিনটি আইন—১৯২০ সালের পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইন্টু ইন্ডিয়া) অ্যাক্ট, ১৯৩৯ সালের রেজিস্ট্রেশন অব ফরেইনারস অ্যাক্ট এবং ১৯৩৬ সালের ফরেইনারস অ্যাক্ট—এর পরিবর্তে নতুন একটি আইনের ভিত্তি তৈরি হবে।
এই খসড়া বিলের উদ্দেশ্য হল, ভারতের ইমিগ্রেশন সম্পর্কিত বর্তমান আইনগুলির সংস্কার এবং আধুনিকীকরণ। বর্তমান আইনের অধিকাংশই “প্রাক-সংবিধানকালীন” এবং সেগুলি মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল। তাই সরকারের মতে, এই আইনগুলি বর্তমান যুগের চাহিদা অনুযায়ী কার্যকরী নয় এবং এটি পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে।
ইমিগ্রেশন এবং ফরেইনারস বিল, ২০২৫-এর বৈশিষ্ট্য:
এই বিলের লক্ষ্য হল, বিদেশি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশ, অবস্থান এবং প্রস্থান সংক্রান্ত পদ্ধতিগুলিকে আরও সহজ এবং কার্যকরী করা। এটি সরকারকে বিদেশি নাগরিকদের ওপর আরও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রদান করবে। বিশেষত, বিলটিতে উল্লেখ করা হয়েছে:
১. বিউরো অব ইমিগ্রেশন প্রতিষ্ঠা: এই বিলটি একটি “বিউরো অব ইমিগ্রেশন” প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব রাখে, যা বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশ এবং অবস্থান সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
২. জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য: এই বিলের মাধ্যমে সরকার বিদেশি নাগরিকদের ভারতে প্রবেশ বা অবস্থান নিষিদ্ধ করতে পারবে, যদি তা দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা বা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।
৩. বিশেষ শ্রেণির নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ: সরকার বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশ এবং প্রস্থান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে এবং এটি বিশেষ শ্রেণির নাগরিকদের জন্য নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে।
৪. নির্দিষ্ট সময় এবং পথ: একটি বিদেশি নাগরিক ভারতে প্রবেশ করতে চাইলে, তাকে নির্দিষ্ট সময়, পথ এবং বন্দর ব্যবহার করতে হবে এবং সেই সময় তার আগমনের শর্তগুলি পালন করতে হবে।
৫. বিশেষ অঞ্চলে অবস্থান নিষেধ: সরকার প্রয়োজনে, বিদেশি নাগরিকদের কোনও “বিশেষ অঞ্চল”-এ অবস্থান নিষিদ্ধ করতে পারে, যা দেশের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
ভারতের মন্ত্রীসভার সদস্য, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ইউনিয়ন তালিকার অধীনে আইন প্রণয়ন করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। তিনি বলেন, “পর্যটকদের ভারতে আসার জন্য স্বাগত জানানো হলেও, সরকারের দায়িত্ব হলো দেশের শান্তি এবং সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা।” সরকারও উল্লেখ করেছে যে, এটি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বিরোধী দলগুলি এই বিলটির বিরুদ্ধে নানা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কংগ্রেস নেতা মণীশ তেওয়ারি দাবি করেছেন যে, এই বিলটি সংবিধানের একাধিক বিধান লঙ্ঘন করছে। তিনি বলেন, “এই বিলটি মৌলিক অধিকারগুলির বিরুদ্ধে এবং সরকারের উদ্দেশ্য হতে পারে, তাদের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে অমিল থাকা ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা।” তিনি আরও বলেন, এই বিলের মাধ্যমে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা সৌগত রায়ও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই নতুন আইনটি বিদেশি মেধাবী কর্মীদের ভারতে আসা বন্ধ করতে পারে, যা ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রযুক্তি, শিক্ষায় এবং গবেষণায় ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি আশঙ্কা করেছেন যে, এই আইনের ফলে ভারতে বিদেশি মেধার প্রবাহ কমে যাবে, যা দেশের উন্নয়নের জন্য খারাপ প্রভাব ফেলবে।
বিলের প্রভাব:
এই বিলটি সরকারকে বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশ এবং অবস্থান সংক্রান্ত ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করবে। এটি দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তবে বিরোধীরা মনে করেন যে এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে, বিশেষত যদি সরকারের কাছে বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশ বা অবস্থান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অত্যাধিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। বিরোধী দলের উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে যে, এই আইনটি মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারে।
ইমিগ্রেশন এবং ফরেইনারস বিল, ২০২৫-এ সরকার যে পরিবর্তনগুলো আনার চেষ্টা করছে, তা দেশটির নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই বিলের কিছু বিধান বিরোধী দলের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তারা মনে করছেন, এই আইনটি মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ভবিষ্যতে আরও আলোচনা এবং সংশোধনের মাধ্যমে এই আইনটি দেশের সবার স্বার্থে কার্যকরী হতে পারে।