নেসলের ভারতীয় শাখার উপর ৬৯ লক্ষ টাকার কর জরিমানা – কারণ কী?

নেসলে ইন্ডিয়া লিমিটেড (Nestlé India) ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় খাদ্য ও পানীয় সংস্থা, সম্প্রতি একটি বড় আর্থিক জরিমানার সম্মুখীন হয়েছে। বুধবার সংস্থাটি ঘোষণা করেছে যে, কাস্টমস…

Nestlé India Faces ₹69 Lakh Tax Penalty Amid Customs Duty Dispute

নেসলে ইন্ডিয়া লিমিটেড (Nestlé India) ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় খাদ্য ও পানীয় সংস্থা, সম্প্রতি একটি বড় আর্থিক জরিমানার সম্মুখীন হয়েছে। বুধবার সংস্থাটি ঘোষণা করেছে যে, কাস্টমস অ্যাক্ট, ১৯৬২-এর অধীনে জারি করা একটি পূর্ববর্তী আদেশকে সমর্থন করার পর, তাদের উপর ৬৯.৪৫ লক্ষ টাকার কর জরিমানা আরোপ করা হয়েছে। এই জরিমানার মূল কারণ হলো একটি কাস্টমস ডিউটি সংক্রান্ত বিরোধ। সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে ডেপুটি কমিশনার অফ কাস্টমসের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল। কিন্তু আপিল কর্তৃপক্ষ এই আবেদন খারিজ করে দিয়ে কাস্টমস ডিউটি, সুদ এবং সমপরিমাণ জরিমানার দাবি নিশ্চিত করেছে।

এই জরিমানার কারণ কী?

নেসলে ইন্ডিয়া স্টক এক্সচেঞ্জে দাখিল করা একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, তারা কাস্টমস অ্যাক্টের ধারা ২৮ (৪) এবং ধারা ২৮এএ-এর অধীনে এই জরিমানার আদেশ পেয়েছে। সংস্থাটি এই আদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করলেও, শেষ পর্যন্ত রাজস্ব বিভাগের পক্ষেই রায় গেছে। তবে নেসলে ইন্ডিয়া জানিয়েছে, “উপরোক্ত আদেশের ফলে সংস্থার আর্থিক, কার্যক্রম বা অন্যান্য কার্যকলাপের উপর কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না। আমরা এই আদেশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য বিভিন্ন বিকল্প খতিয়ে দেখব।”

বুধবার বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে (বিএসই) নেসলে ইন্ডিয়ার শেয়ার প্রতি ২,২৪০.১০ টাকায় বন্ধ হয়েছে। সংস্থাটি এই জরিমানার পরেও তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থিতিশীলতার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এটি নেসলের জন্য একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। সম্প্রতি, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) নেসলে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে ইনসাইডার ট্রেডিং নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি সতর্কতা পত্র জারি করেছে। এই ঘটনাটি সংস্থার একজন সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে যুক্ত।

সেবি-র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারের মাধ্যমে নেসলে ইন্ডিয়ার কমপ্লায়েন্স অফিসার (সিসিও)-কে এই সতর্কতা পত্র পাঠানো হয়েছে। সংস্থাটি স্টক এক্সচেঞ্জে দাখিল করা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, তারা গত ৬ মার্চ ২০২৫ তারিখে সেবি-র এই চিঠি পেয়েছে। এই লঙ্ঘনটি একটি “কন্ট্রা ট্রেড” এর সঙ্গে সম্পর্কিত। কন্ট্রা ট্রেড বলতে এমন একটি লেনদেন বোঝায়, যেখানে একজন ইনসাইডার ছয় মাসের মধ্যে একই সিকিউরিটির পূর্ববর্তী লেনদেনের বিপরীতে শেয়ার ক্রয় বা বিক্রয় করে, যার লক্ষ্য থাকে স্বল্পমেয়াদি লাভ। সেবি-র নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ, কারণ এটি অপ্রকাশিত মূল্য-সংবেদনশীল তথ্যের অপব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি করে।

নেসলে ইন্ডিয়া এই বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেছে যে, সেবি-র এই সতর্কতা পত্রের ফলেও সংস্থার আর্থিক বা কার্যক্রমের উপর কোনো বড় প্রভাব পড়বে না। তবে এই ঘটনাগুলো নেসলের মতো একটি বহুজাতিক সংস্থার জন্য নিয়ন্ত্রক চাপের ইঙ্গিত দেয়। এর মধ্যেই সংস্থাটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দিয়েছে। কফি, কোকো এবং ভোজ্য তেলের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে তারা তাদের পণ্যের দাম সামান্য বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

কাস্টমস জরিমানার পটভূমি

নেসলে ইন্ডিয়ার উপর আরোপিত এই জরিমানার মূল কারণ হলো আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত কাস্টমস নিয়মের লঙ্ঘন। কাস্টমস অ্যাক্টের ধারা ২৮ (৪) অনুযায়ী, যদি কোনো সংস্থা কর ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে বা নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তবে জরিমানা ও সুদসহ শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে নেসলে প্রাথমিকভাবে দাবি করেছিল যে, তাদের উপর আরোপিত শুল্কের পরিমাণ অযৌক্তিক। কিন্তু আপিল কর্তৃপক্ষ এই যুক্তি গ্রহণ করেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের বিরোধ বহুজাতিক সংস্থাগুলোর জন্য নতুন কিছু নয়। ভারতে কঠোর কর ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর কারণে অনেক সংস্থাকেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে নেসলে ইন্ডিয়ার দাবি, এই জরিমানা তাদের ব্যবসার উপর বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছুটা স্বস্তির খবর।

Advertisements

সেবি-র সতর্কতা ও ইনসাইডার ট্রেডিং

সেবি-র সতর্কতা পত্রটি নেসলের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয়। ইনসাইডার ট্রেডিং নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ গুরুতর হলেও, নেসলে জানিয়েছে যে এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং সংস্থার সামগ্রিক কার্যক্রমের উপর এর প্রভাব নগণ্য। তবে এই ঘটনা বাজারে সংস্থার সুনামের উপর প্রশ্ন তুলতে পারে।

পণ্যের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা

বৈশ্বিক বাজারে কফি, কোকো এবং ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নেসলে ইন্ডিয়া তাদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় বাজারে ম্যাগি নুডলস, নেসক্যাফে কফি এবং কিটক্যাট চকোলেটের মতো জনপ্রিয় পণ্যের দামে এই বৃদ্ধি প্রভাব ফেলতে পারে। সংস্থাটি জানিয়েছে যে, এই দাম বৃদ্ধি “সামান্য” হবে এবং গ্রাহকদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করার চেষ্টা করা হবে।

বাজার ও ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া

নেসলে ইন্ডিয়ার এই ঘটনাগুলো বিনিয়োগকারী এবং ভোক্তা উভয়ের মধ্যেই আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংস্থাটির শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তি এবং ব্র্যান্ড মূল্যের কারণে এই জরিমানা বা সতর্কতা তাদের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তবে ভোক্তারা পণ্যের দাম বৃদ্ধির খবরে কিছুটা উদ্বিগ্ন।

শেষ পর্যন্ত, নেসলে ইন্ডিয়া এই চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করে এবং ভারতীয় বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।