প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ( Narendra Modi) সরকারের “আত্মনির্ভর ভারত” অভিযান যে ভারতকে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার শীর্ষে নিয়ে যাবে, সেই প্রতিশ্রুতি আজ আর ততটা কার্যকর মনে হচ্ছে না। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড স্তরে পৌঁছে গেছে—৯৯.২ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্কটি ভারতের অর্থনৈতিক নীতির একটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে করেছে। চীন থেকে আমদানি ১১৩.৫ বিলিয়ন ডলারের মাত্রা ছুঁয়েছে, যেখানে রপ্তানি মাত্র ১৪.২ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ। এই বিশাল ব্যবধান ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা ও বৈদেশিক বাণিজ্য নীতির দিকে আলোকপাত করে।
আত্মনির্ভরতা: একটি দূরের স্বপ্ন?
“আত্মনির্ভর ভারত” নীতি ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময় প্রধানমন্ত্রী মোদী দ্বারা চালু করা হয়েছিল। এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক নির্ভরতা কমানো। তবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির এই রেকর্ড ভারতের এই লক্ষ্যে কতটা পিছিয়ে পড়েছে, তা স্পষ্ট। অর্থনীতিবিদ স্বামীনathan Aiyar-এর মতে, আত্মনির্ভরতা শুধু স্বাবলম্বন নয়, স্বচ্ছলতারও প্রতীক হওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত চীনের তৈরি পণ্য—ইলেকট্রনিক্স, যন্ত্রপাতি এবং রাসায়নিক পদার্থ—এর উপর এতটাই নির্ভরশীল যে, এই ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের এই অসমতা রয়েছে তাদের সুরক্ষাবাদী (protectionist) নীতির কারণে। চীন আপন দেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের প্রবেশকে সীমিত করে রাখে এবং স্থানীয় শিল্পকে সরকারি সহায়তা প্রদান করে। ২০২২ সালের একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চীনের এই নীতি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তবে ছোটো দৈর্ঘ্যে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়। এদিকে ভারতের “মেক ইন ইন্ডিয়া” প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশীয় উৎপাদন ক্ষমতা এখনো চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি।
বর্তমান পরিস্থিতি: আমদানি বনাম রপ্তানি
২০২৫ সালের মার্চ মাসে ভারতের চীনের রপ্তানি ১৪.৫% কমে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যা ট্রেডিং ইকনমিক্স-এর সর্বশেষ তথ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো চীনের সস্তা পণ্যের বাজারে দাপট। ভারতীয় শিল্পের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ দেশীয় কোম্পানিগুলো এখনো সেই স্তরে পৌঁছতে পারেনি যেখান থেকে তারা চীনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে।
অন্যদিকে, ভারতীয় রপ্তানি মূলত কাঁচামাল ও কিছু ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যে সীমাবদ্ধ। চীন এই পণ্যগুলোর উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজের উৎপাদন বাড়াচ্ছে। ফলে ভারতের রপ্তানি বাজার আরো সঙ্কুচিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বিস্তার করতে হবে এবং দেশীয় শিল্পকে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া উচিত।
সমাধানের পথ: কী করা যায়?
ভারতের জন্য এই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ অবলম্বন করা জরুরি। প্রথমত, “মেক ইন ইন্ডিয়া” প্রকল্পের অধীনে ছোট ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করা হোক। দ্বিতীয়ত, চীনের সস্তা পণ্যের বিকল্প হিসেবে ভারতীয় বাজারে গুণমানপূর্ণ পণ্য উৎপাদন করতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রযুক্তিগত উন্নতি আনা জরুরি, যা মোদী সরকারের নতুন শিক্ষা নীতির একটি অংশ হতে পারে।
এছাড়া, ভারতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাড়াতে হবে, যাতে আমদানির উৎস বিভিন্নায়ন করা যায়। রক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর সাম্প্রতিক বিবৃতি অনুযায়ী, ২০২৫-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে ভারতের রক্ষা রপ্তানি ৭৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশীয় উৎপাদনের একটি ইতিবাচক সংকেত। তবে এই সাফল্যকে অন্য শিল্পে প্রয়োগ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির এই রেকর্ড ভারতের অর্থনৈতিক নীতির পুনর্বিবেচনা করার কথা জোর দেয়। মোদীর “আত্মনির্ভর ভারত” গল্পটি এখনো শেষ হয়নি, কিন্তু এর কার্যকারিতা প্রমাণ করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, বাজার বিস্তার এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি—এই তিনটি ক্ষেত্রে ফোকাস না থাকলে ভারতের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একটি দূরের স্বপ্নই থেকে যাবে। চীনের সঙ্গে এই অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে ভারতকে চালাকি ও কৌশলের প্রয়োগ করতে হবে, নতুবা এই ঘাটতি আরো বেড়ে চলবে।