টাইম ম্যাগাজিনের প্রথমবারের মতো প্রকাশিত ‘টাইম ১০০ মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পিপল ইন ফিলানথ্রপি ২০২৫’ (TIME100 Most Influential) তালিকায় স্থান পেয়েছেন ভারতের শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি, রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন নীতা আম্বানি, উইপ্রোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজি এবং জিরোধা কো-ফাউন্ডার নিখিল কামাথ। এই তালিকা এমন দাতা এবং ফাউন্ডেশন ও অলাভজনক সংস্থার নেতাদের সম্মানিত করেছে, যাঁরা সমাজের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছেন। টাইম ম্যাগাজিনের মতে, এই ব্যক্তিরা তাদের সাহসী দান এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দানশীলতার চেহারা বদলে দিচ্ছেন। এই তালিকায় ভারতীয়দের পাশাপাশি ফুটবল কিংবদন্তি ডেভিড বেকহ্যাম, আমেরিকান দাতা ওয়ারেন বাফেট, মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রিন্স উইলিয়াম ও ক্যাথরিন, প্রিন্সেস অফ ওয়েলসের মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিরাও স্থান পেয়েছেন।
মুকেশ ও নীতা আম্বানি: ভারতের শীর্ষ দাতাদের মধ্যে
টাইম ম্যাগাজিন জানিয়েছে, মুকেশ ও নীতা আম্বানি ২০২৪ সালে ৪০৭ কোটি টাকা (প্রায় ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) দান করেছেন, যা তাঁদের ভারতের শীর্ষ দাতাদের মধ্যে স্থান দিয়েছে। তাঁদের দানশীলতার পরিধি তাঁদের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মতোই বৈচিত্র্যময়। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুকেশ আম্বানি এবং রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারপার্সন নীতা আম্বানি লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের জীবনে প্রভাব ফেলেছেন। তাঁদের দান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ত্রাণ এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিস্তৃত।
নীতা আম্বানি, যিনি মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ক্রিকেট দলের মালিক, বিশেষ করে মহিলা ক্রীড়াবিদদের উন্নয়নে তাঁর অবদানের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, “পেশাদার ক্রীড়ায় মহিলাদের যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, তা বিবেচনা করলে তাঁদের সাফল্য আরও বিশেষ।” রিলায়েন্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি স্কলারশিপ প্রদান, মহিলাদের ক্যারিয়ার দক্ষতা বৃদ্ধি, গ্রামীণ সম্প্রদায়ের টেকসই কৃষি উদ্যোগ, জল সংরক্ষণ প্রকল্প, হাসপাতাল নির্মাণ, দৃষ্টি সমস্যায় সহায়তা এবং স্কুলের অবকাঠামো উন্নতির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন।
আজিম প্রেমজি: শিক্ষায় রূপান্তরকারী অবদান
টাইম ম্যাগাজিন উইপ্রোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান আজিম প্রেমজিকে ভারতের অন্যতম সম্মানিত দাতা হিসেবে উল্লেখ করেছে। ২০১৩ সালে গিভিং প্লেজে স্বাক্ষর করে তিনি উইপ্রোর শেয়ারের মাধ্যমে তাঁর ফাউন্ডেশনের জন্য ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি দান করেছেন। আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশন ভারতের পাবলিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কাজ করে, ৫৯টি ফিল্ড অফিস এবং ২৬৩টি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ৮০ লক্ষেরও বেশি শিশুকে সহায়তা করেছে। গত বছর ফাউন্ডেশনটি ৯৪০টি সংস্থাকে ১০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে এবং আগস্টে স্কুল মিল প্রোগ্রাম সম্প্রসারণের জন্য ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
টাইম উল্লেখ করেছে যে, প্রেমজির দানশীলতার দর্শন মহাত্মা গান্ধীর ধারণা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত, যিনি সম্পদকে সমাজের উন্নতির জন্য একটি পাবলিক ট্রাস্ট হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।
নিখিল কামাথ: গিভিং প্লেজের সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয়
জিরোধার কো-ফাউন্ডার নিখিল কামাথ ২০২৩ সালে ৩৬ বছর বয়সে গিভিং প্লেজে স্বাক্ষর করে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। হাইস্কুল ড্রপআউট হিসেবে তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল বেঙ্গালুরুর একটি কল সেন্টারে, কিন্তু তিনি তাঁর ভাই নিথিন কামাথের সঙ্গে জিরোধা প্রতিষ্ঠা করে ভারতের অন্যতম সফল ব্রোকারেজ ফার্ম গড়ে তুলেছেন। তাঁরা তাঁদের রেইনম্যাটার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জলবায়ু সমাধানের জন্য ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
নিখিল কামাথ ইয়ং ইন্ডিয়া ফিলানথ্রপিক প্লেজ (ওয়াইআইপিপি) প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ৪৫ বছরের কম বয়সী এবং ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সম্পদের অধিকারী ভারতীয়দের তাঁদের সম্পদের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ দান করতে উৎসাহিত করে। এই উদ্যোগ ইতিমধ্যে ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে, যা ৩০০টি স্কুলে ডিজিটাল অবকাঠামো, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং অন্যান্য সহায়তা পরিষেবার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কামাথ টাইমকে বলেছেন, “শিক্ষাই একমাত্র গণতান্ত্রিক উপাদান, যা অসমতার ব্যবধান কমাতে পারে।”
অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
টাইম১০০ ফিলানথ্রপি তালিকায় ডেভিড বেকহ্যাম, ওয়ারেন বাফেট, মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস এবং প্রিন্স উইলিয়াম ও ক্যাথরিনের মতো বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিরা স্থান পেয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেসিকা সিবলি বলেছেন, “এই তালিকা দানশীলতার ভবিষ্যৎ গঠনকারী ব্যক্তি ও ধারণাগুলোকে তুলে ধরে।” তালিকাটি শিল্প, বিনোদন, প্রযুক্তি, ক্রীড়া এবং একাডেমিয়ার মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে।
ভারতীয় দানশীলতার ক্রমবর্ধমান প্রভাব
টাইম ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছে যে, বিশ্বব্যাপী সরকারি ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় দানশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আম্বানি, প্রেমজি এবং কামাথের মতো ভারতীয়রা তাঁদের দানের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গ্রামীণ উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছেন। তাঁদের এই অবদান ভারতের দানশীলতার সংস্কৃতিকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরেছে।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রথম ফিলানথ্রপি তালিকায় মুকেশ ও নীতা আম্বানি, আজিম প্রেমজি এবং নিখিল কামাথের স্থান পাওয়া ভারতের দানশীলতার ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রমাণ। তাঁদের বিভিন্ন উদ্যোগ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রীড়া এবং জলবায়ু সমাধানের মতো ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে। এই তালিকা শুধু তাঁদের অবদানের স্বীকৃতিই নয়, বরং ভারতের সমাজকল্যাণে দানশীলতার গুরুত্বও তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের উদ্যোগ ভারতের তরুণ প্রজন্মকে আরও দানশীল হতে উৎসাহিত করবে বলে আশা করা যায়।