শিল্পপতি মুকেশ আম্বানি (Mukesh Ambani)। ব্যবসা ভালো বোঝেন তিনি। বাণিজ্যিক পথে ক্ষমতা দখল, তারপর সব নিয়ন্ত্রণ। এটাই শিল্পপতিদের কৌশল। এভাবেই ভারতে প্রায় ২০০ বছর রাজত্ব করে ইংরেজরা। একই পথে হাঁটেন বর্তমান যুগের শিল্পপতিরাও।
বিশ্বব্যাপী মাথা উঁচু করে উঠেছে—রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক মুকেশ আম্বানী তাদের পুরোনো ব্র্যান্ড ক্যাম্পা কোলাকে (Campa Cola) নেপালে উন্মোচন করেছেন। এই পদক্ষেপটি শুধু ব্যবসায়িক একটি বিস্তার নয়, বরং একটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ যা নেপালের তরল পানীয় বাজারে রিলায়েন্সের প্রভাব বাড়াতে পারে। ক্যাম্পা কোলা, যিনি এক সময় ভারতের সফট ড্রিঙ্ক বাজারে অধিপতি ছিলেন, আবারও একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু করেছে, এবারে নেপালের মাটিতে। এই উদ্যোগটি মুকেশ আম্বানীর ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যিনি আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই পুরোনো ব্র্যান্ডটিকে পুনরুদ্ধার করেছেন।
ক্যাম্পা কোলার পুনর্জন্ম
ক্যাম্পা কোলার ইতিহাস ভারতের সফট ড্রিঙ্ক শিল্পের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ১ ৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে পিউর ড্রিঙ্কস গ্রুপের অধীনে এই ব্র্যান্ডটি ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে বাজারের শীর্ষে ছিল। তবে ১৯৯০-এর দশকে কোকাকোলা এবং পেপসির প্রবেশের পরে এর জনপ্রিয়তা কমে গিয়েছিল। ২০২৩ সালে রিলায়েন্স কনজিউমার প্রোডাক্টস লিমিটেড (RCPL) ক্যাম্পা ব্র্যান্ডটিকে পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং এখন নেপালে এর প্রথম আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ। নেপালে এই ব্র্যান্ডটির উৎপাদন এবং বিতরণের দায়িত্ব চৌধুরী গ্রুপের হাতে দেওয়া হয়েছে, যা দেশীয় বাজারে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
নেপাল বাজারে কেন ক্যাম্পা?
নেপালের সফট ড্রিঙ্ক বাজার সম্প্রতি স্থিতিশীল বৃদ্ধি দেখাচ্ছে, যা স্বাস্থ্য সচেতন উপভোগতাদের দ্বারা চালিত হচ্ছে। স্ট্যাটিস্টার ২০২৫-এর বাজার প্রকাশনা অনুসারে, দেশীয় এবং আঞ্চলিক ব্র্যান্ডগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, যা ক্যাম্পার জন্য একটি স্বাভাবিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। রিলায়েন্স এই বাজারে কোকাকোলা ও পেপসির মতো বড় ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার পরিবর্তে গ্রামীণ এবং অর্ধশহরত্বীয় অঞ্চলের মূল্য-সচেতন গ্রাহকদের লক্ষ্য করেছে। ২০২৪ সালের টাইমস অফ ইন্ডিয়া প্রতিবেদন অনুসারে, ক্যাম্পার ২৫০ মিলি বোতলের দাম প্রতিযোগীদের তুলনায় ২০-৩০% কম, যা এটিকে বাজারে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
কৌশলগত দৃষ্টিকোণ
মুকেশ আম্বানীর এই পদক্ষেপটি শুধুমাত্র মূল্য নির্ধারণে নয়, বরং বিতরণ নেটওয়ার্কে ও গ্রাহক সংযোগে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। RCPL-এর নির্দেশক কেতন মোদি বলেছেন, “আমরা নেপালে ক্যাম্পার সম্ভাবনা দেখছি এবং মাঝারি মূল্যে গুণমানপূর্ণ পণ্য দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি।” চৌধুরী গ্রুপের সঙ্গে সহযোগিতা এই কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা স্থানীয় উৎপাদন ও বিতরণের মাধ্যমে খরচ কমিয়ে দ্রুত বাজার প্রবেশের পথ তৈরি করবে। এছাড়া, ক্যাম্পার নস্টালজিক মূল্যও একটি বড় অস্ত্র হতে পারে। ভারতীয় মিলেনিয়ালদের মধ্যে এই ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা ২০২৩ সালের জার্নাল অফ কনজিউমার বিহেভিয়রের একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যা নেপালেও একইভাবে কাজ করতে পারে।
প্রতিযোগিতা ও ভবিষ্যৎ
কোকাকোলা ও পেপসির মতো ব্র্যান্ডগুলো নেপালে শক্ত মূলধান রয়েছে, তবে ক্যাম্পার কম দামে এবং স্থানীয় সংযোগের মাধ্যমে একটি ভিন্ন বাজার খন্ড দখল করার চেষ্টা করছে। ব্যবসায়িক বিশ্লেষকদের মতে, নেপালের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের সফট ড্রিঙ্ক বাজারে ক্যাম্পা যদি গ্রামীণ অঞ্চলে পায়ের দাগ গাঢ় করে, তবে এটি একটি বড় সফলতা হবে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়—ব্র্যান্ডের প্রচার এবং গুণমান নিয়ন্ত্রণে সঠিক কৌশল প্রয়োগ না হলে বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে।
মুকেশ আম্বানীর এই “তরল পথে” নেপাল দখলের পরিকল্পনা তাঁর ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। ক্যাম্পা কোলার পুনর্জন্ম ও আন্তর্জাতিক বিস্তার তাঁর সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে পারে, যেখানে বাজারের প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি ভারতীয় ব্র্যান্ড বিশ্বমঞ্চে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। নেপালে এই শুরুতটি কেবল একটি ব্যবসায়িক পদক্ষেপ নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের একটি নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। ভবিষ্যতে ক্যাম্পার কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে স্থানীয় গ্রাহকদের পছন্দ এবং রিলায়েন্সের বাজার কৌশলের উপর। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—মুকেশ আম্বানীর এই পদক্ষেপ ব্যবসা জগতের জন্য একটি আকর্ষণীয় গল্পের শুরু।