ভারতে চালের বাজারে গত কয়েকদিনে এক ধাক্কায় ১৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি নজরে এসেছে, যা কৃষি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম মূল কারণ বাংলাদেশের বাড়তি আমদানি চাহিদা। প্রতিবেশী দেশটি সম্ভাব্য ফসলের ক্ষতির আশঙ্কায় প্রায় ৯ লক্ষ টন চাল আমদানির (Rice Import Policy) পরিকল্পনা করেছে, যা সরাসরি ভারতের চাল শিল্পকে প্রভাবিত করছে। বিশ্বের মোট চাল রফতানির প্রায় ৪৬ শতাংশ ভারতের হাতে থাকায়, এ পরিস্থিতি ভারতীয় রফতানিকারকদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশের চাল আমদানি পরিকল্পনা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণে আমন ধানের ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এর জেরে দেশটি ৯ লক্ষ টন চাল আমদানির ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে ৪ লক্ষ টন সরকারি টেন্ডারের মাধ্যমে এবং ৫ লক্ষ টন বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি হবে। ভৌগোলিক নৈকট্য, পর্যাপ্ত মজুত এবং প্রতিযোগিতামূলক দামের কারণে ভারতের অংশগ্রহণ এখানে স্বাভাবিকভাবেই বড় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রাইসভিলা ফুডসের সিইও সুরজ আগরওয়াল বলেন, “বাংলাদেশের এই বাড়তি চাহিদা ভারতের জন্য বিরাট রফতানি সম্ভাবনা তৈরি করেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহারের মিলগুলো বিশেষভাবে লাভবান হবে। বাংলাদেশের বেসরকারি আমদানির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকেই আসবে।”
মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব
এই আমদানির খবর প্রকাশের পর ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারেই চালের দাম বেড়ে গেছে।
- ‘স্বর্ণ মনসুরি’ পারবোইল্ড চালের দাম ২৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩১-৩২ টাকা প্রতি কেজিতে পৌঁছেছে।
- জনপ্রিয় ‘মিনিকেট’ চালের দাম ৪১-৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা প্রতি কেজি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
- পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ ভারতের বাজারে ব্যবহৃত জনপ্রিয় প্রজাতি—‘স্বর্ণা’, ‘রত্না’, ‘সোনা মসুরি’—সবকটির দামই ঊর্ধ্বমুখী। এর ফলে একদিকে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা উপকৃত হলেও, সাধারণ ভোক্তাদের জন্য দৈনন্দিন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি
বাংলাদেশ সরকার ‘খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি’র আওতায় ৫৫ লক্ষ পরিবারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল ১৫ টাকা কেজি দরে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে এই বিতরণ চলবে। ইতিমধ্যেই ৩.৭৬ লক্ষ টন বোরো ধান ও ৯.৫০ লক্ষ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে, যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ লক্ষ টন। ফলে অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে ভারতের আমদানি অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের রফতানি নীতি ও প্রেক্ষাপট
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশগুলির একটি। তবে অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বছর চাল, গম ও চিনির রফতানিতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তবুও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষি রফতানি ৫৩ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করেছে। বাংলাদেশের এই নতুন চাহিদা সেই রফতানি বাজারে নতুন প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের বাড়তি ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গের মিলগুলো বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। জয় বাবা বাক্রেশ্বর রাইস মিলের ডিরেক্টর রাহুল আগরওয়াল বলেন, “আমরা সরকারি টেন্ডারেও অংশ নেব, পাশাপাশি বেসরকারি অর্ডারেও সরবরাহ করব। এতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনই রাজ্যের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
যদিও পরিস্থিতি অনুকূল, কিছু জটিলতা থেকেই যাচ্ছে—
- রফতানি নীতি: বাসমতি চালের ন্যূনতম রফতানি মূল্য (MEP) নিয়ে সরকারী নীতির পরিবর্তন বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ বাজারের চাপ: দাম দ্রুত বাড়তে থাকলে সরকার স্থানীয় বাজারে চাপ কমাতে রফতানিতে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে।
- কূটনৈতিক টানাপোড়েন: পেট্রাপোল সীমান্তে পোশাক ও পাটপণ্য আমদানিতে ভারতের বিধিনিষেধ দুই দেশের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে রফতানিকারকদের ধারণা, এই বাধাগুলি খুব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না। বিশাখাপত্তনম ও পারাদ্বীপ বন্দরের মতো প্রধান রফতানি রুটগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা ডেলিভারি সময় কমাচ্ছে।
বাংলাদেশের চাল আমদানির সিদ্ধান্ত ভারতের কৃষি ও বাণিজ্য খাতকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। একদিকে দাম বাড়ায় কৃষক ও রফতানিকারকরা লাভবান হবেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্যের ব্যয়ও বাড়বে। তাই সরকারের বড় দায়িত্ব হবে রফতানি সুযোগ কাজে লাগানোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো এই পরিস্থিতি থেকে সর্বাধিক লাভ তুলতে প্রস্তুত, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে টেকসই সমাধানের জন্য প্রয়োজন সঠিক কৃষি বিনিয়োগ ও রফতানি পরিকল্পনা।