উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে আজকাল অনেক ছাত্রছাত্রীই শিক্ষা ঋণের (Education Loan) উপর নির্ভর করেন। দেশ বা বিদেশ—যেখানেই পড়াশোনা হোক না কেন, পড়াশোনার ব্যয়ভার সামলাতে এই ঋণ অনেক সময় জীবনদায়ক হয়ে ওঠে। কিন্তু পড়াশোনা চলাকালীনই ঋণ শোধ শুরু করা অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পক্ষেই সম্ভব হয় না। তাই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেয় একটি বিশেষ সুবিধা—মরাটোরিয়াম পিরিয়ড বা স্থগিত পর্ব।
এই মরাটোরিয়াম আসলে একধরনের ‘গ্রেস পিরিয়ড’, যা আপনাকে পড়াশোনা শেষ করতে, চাকরি খুঁজতে এবং আয় শুরু করতে সুযোগ দেয়, তারপরে কিস্তি বা EMI শোধ শুরু হয়। তবে এখানে অনেকেই ভুল বুঝে বসেন—এটি ঋণ মকুব নয়, বরং সুদ জমা হওয়ার সময়। তাই মরাটোরিয়াম মানে যে একেবারে খরচ নেই, তা নয়। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এই সময়টিই পরবর্তীতে ঋণ শোধকে অনেকটা সহজ করে তুলতে পারে।
শিক্ষা ঋণ পাওয়ার নিয়ম ও শর্ত:
একটি স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হলেই শিক্ষা ঋণ পাওয়া তুলনামূলক সহজ হয়। ঋণদাতা সংস্থা বা ব্যাংক সাধারণত প্রতিষ্ঠানটির স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর পারিবারিক আর্থিক অবস্থা এবং সেই প্রতিষ্ঠানের প্লেসমেন্ট রেকর্ড দেখে অনুমোদন দেয়। প্লেসমেন্ট বা চাকরি পাওয়ার ইতিহাস যত ভালো, ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি। তবে অনেক ক্ষেত্রেই পড়াশোনার মোট খরচের একটি অংশ নিজের পকেট থেকেও দিতে হতে পারে।
ঋণের অঙ্ক ৪ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে কোনো জামিনদার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এর বেশি হলে সাধারণত একজন জামিনদার—অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা—এর আয়ের প্রমাণ ও সম্পদের নথি জমা দিতে হয়।
মরাটোরিয়াম পিরিয়ড কীভাবে কাজ করে?
মরাটোরিয়াম পিরিয়ড হলো ঋণের মেয়াদের এমন একটি সময় যখন EMI শোধ করতে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়কাল হয় কোর্স চলাকালীন সময় + পড়াশোনা শেষে আরও ছয় মাস থেকে এক বছর।
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার ডিগ্রি শেষ করতে দুই বছর লাগে এবং ব্যাংক আপনাকে কোর্স শেষের পর আরও এক বছরের মরাটোরিয়াম দেয়, তাহলে আপনার EMI শুরু হবে মোট তিন বছর পর।
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে—এই সময় সুদ কিন্তু জমতেই থাকে। যদি আপনি ১০ লক্ষ টাকা ৯% সুদে সাত বছরের জন্য ধার নেন এবং প্রথম তিন বছর কোনো সুদ শোধ না করেন, তাহলে শুধু সুদের অঙ্কই ২.৭ লক্ষ টাকার বেশি যোগ হবে। অর্থাৎ, পরে আপনার মোট ঋণের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে যাবে।
মরাটোরিয়ামের সময় সুদ শোধ করা কি উচিত?
সম্ভব হলে মরাটোরিয়াম চলাকালীন অন্তত সুদের কিছুটা অংশ শোধ করার চেষ্টা করুন। এতে ভবিষ্যতে ঋণের বোঝা অনেকটা হালকা হবে।
ধরা যাক, আপনার মাসিক সুদের অঙ্ক ৭,৫০০ টাকা। আপনি যদি প্রতি মাসে অন্তত ৩,০০০ টাকা দেন, তাহলেও জমে থাকা সুদ অনেকটাই কমে যাবে। একে বলা যেতে পারে—ঋণ নিয়ন্ত্রণের সক্রিয় কৌশল। এর জন্য পার্ট-টাইম কাজ, ইন্টার্নশিপ বা টিউশন পড়ানো বড় সহায়তা হতে পারে।
সরকারি সুদ ভর্তুকি স্কিম:
ভারত সরকার ‘সেন্ট্রাল সেক্টর ইন্টারেস্ট সাবসিডি স্কিম’ (CSIS) চালু করেছে, যা বার্ষিক আয় ৪.৫ লক্ষ টাকার কম পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য। এই স্কিমের আওতায় ভারতে পড়াশোনার ক্ষেত্রে মরাটোরিয়াম চলাকালীন সুদ সরকারই শোধ করে দেয়। তবে এর জন্য ঋণটি নির্ধারিত ব্যাংক থেকে হতে হবে এবং ঋণের অঙ্ক ৭.৫ লক্ষ টাকার মধ্যে থাকতে হবে।
এছাড়াও অনেক রাজ্য সরকার নিজস্ব সুদ ভর্তুকি প্রকল্প চালু করেছে। তাই ঋণ নেওয়ার আগে নিজের যোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া উচিত।
মরাটোরিয়ামের পর কীভাবে ঋণ শোধ পরিকল্পনা করবেন:
মরাটোরিয়াম শেষ হলে EMI শোধ শুরু হয়—যা মূলধন (Principal) + জমে থাকা সুদ—দুই মিলিয়ে হিসাব হয়। যদি ১০ লক্ষ টাকার ঋণে সুদ জমে মূলধন বেড়ে যায়, তাহলে EMI মাসে ২০,০০০ টাকারও বেশি হতে পারে। কিন্তু যদি আপনি মরাটোরিয়াম চলাকালীন অন্তত সুদ শোধ করেন, তাহলে EMI নেমে আসতে পারে ১৬,০০০ টাকার আশেপাশে। এই পার্থক্য একজন সদ্য পাস করা ও কর্মজীবন শুরু করা ব্যক্তির জন্য বড় স্বস্তি।
তাই মরাটোরিয়ামের শেষ বছর থেকেই বাজেট তৈরি করা, সঞ্চয় গড়ে তোলা এবং সম্ভব হলে ঋণের একটি অংশ অগ্রিম শোধ করা বুদ্ধিমানের কাজ।
মরাটোরিয়াম পিরিয়ড আসলে একটি সেতুবন্ধন—ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনে যাওয়ার পথটিকে সহজ করার জন্য। কিন্তু এটিকে ‘ঋণ ছুটি’ ভেবে বসলে ভুল হবে। সুদ জমে যাওয়ার প্রভাব অনেক বড় হতে পারে। তাই ঋণ নেওয়ার মুহূর্ত থেকেই এর খরচ ও পরিণতি বোঝা জরুরি, এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সক্রিয়ভাবে শোধের পরিকল্পনা শুরু করাই সবচেয়ে ভালো কৌশল।