ভারতে জাতীয় সড়ক (National Highways) পরিকাঠামোর সম্প্রসারণ এবং ডিজিটাল পদ্ধতির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে টোল আদায়ের (Toll Revenue) পরিমাণে এক বিশাল উল্লম্ফন দেখা গেছে। চলতি আর্থিক বছর ২০২৪-২৫-এর প্রথম তিন মাসেই কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় মহাসড়ক থেকে টোল আদায় করেছে ৬১,৪০০ কোটি টাকারও বেশি। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতিদিন গড়ে ১৬৮.২৪ কোটি টাকা সরকার কেবলমাত্র রাস্তা থেকেই উপার্জন করছে।
এই অভূতপূর্ব আয়ের উৎসে যেমন রয়েছে ফাস্ট্যাগ (FASTag)-এর ব্যাপক বিস্তার, তেমনই রয়েছে ক্রমবর্ধমান সড়ক পরিবহন, বাণিজ্যিক যাত্রা এবং নতুন এক্সপ্রেসওয়ের সংখ্যা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যেখানে জাতীয় হাইওয়ে থেকে প্রাপ্ত টোলের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৩,০০০ কোটি টাকা, সেখানে এবছর সেই পরিমাণ ১৫ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
✅ ফাস্ট্যাগ ব্যবস্থার কারণে বৃদ্ধি
২০১৯ সাল থেকে জাতীয় হাইওয়েতে FASTag বাধ্যতামূলক হওয়ার পর থেকেই ইলেকট্রনিক টোল আদায় পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই ব্যবস্থা চালুর ফলে শুধু যে যানজট কমেছে তা-ই নয়, তদ্বিপরীত, টোল সংগ্রহ ব্যবস্থাও অধিক স্বচ্ছ ও দ্রুত হয়েছে।
FASTag ব্যবস্থার মাধ্যমে টোল আদায় বর্তমানে দেশের প্রায় ৯৮% টোল প্লাজায় কার্যকর হয়েছে। NHAI জানাচ্ছে, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৬ কোটির বেশি FASTag লেনদেন হচ্ছে।
📉 তবু প্রশ্ন উঠছে এই টাকার ব্যবহারে
যদিও সরকারের দাবি, এই বিপুল পরিমাণ টোল রাজস্ব জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়নে ও রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হচ্ছে, তথাপি সাধারণ মানুষের প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে: এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সড়কের গুণগত মানে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে?
সামাজিক মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে বিভিন্ন টোল প্লাজায় গাড়িচালকদের প্রতি ১০০ কিমি রাস্তার জন্য ₹১২০ থেকে ₹১৫০ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে, সেখানে একাধিক জাতীয় সড়কে এখনো গর্ত, অসমাপ্ত রাস্তাও চোখে পড়ে।
এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা আদায় করছেন সরকার, কিন্তু NH34 বা NH19 তে এখনো চলা মানেই আতঙ্ক। রাস্তায় গর্ত, অর্ধনির্মিত ব্রিজ, কোথাও আলোর অভাব।”
💰 সরকারের বক্তব্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করী জানিয়েছেন, “আমরা চাই ভারতের হাইওয়ে সিস্টেম আমেরিকার থেকেও উন্নত হোক। আমাদের লক্ষ্য ২০২৭-এর মধ্যে ২ লাখ কিলোমিটার হাইওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করা। FASTag থেকে প্রাপ্ত অর্থ সেই লক্ষ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, ২০২৫ সাল থেকে “Annual Toll Pass” চালু হবে—যেখানে মাত্র ₹৩০০০ খরচ করে গাড়িচালকরা এক বছরের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক টোল পয়েন্টে আনলিমিটেড যাতায়াত করতে পারবেন। এটা জনগণের উপর থেকে টোল বোঝা কিছুটা কমাবে।
😐 বিরোধী দলের প্রশ্ন
বিরোধীরা বলছে, যেখানে সরকার রাস্তা থেকেই দৈনিক ₹১৬৮ কোটি আদায় করছে, সেখানে দেশের বহু রাজ্যে আজও গ্রামীণ রাস্তাগুলো মেরামতের অযোগ্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
বামপন্থী অর্থনীতিবিদ দেবজ্যোতি গুহ বলছেন, “ভারতের সড়ক উন্নয়নের খরচ এবং প্রাপ্ত টোলের মধ্যে ভারসাম্য নেই। কিছু এক্সপ্রেসওয়ে ছাড়া অধিকাংশ টোল রাস্তাই ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। জনগণের পকেট কাটাই যেন উদ্দেশ্য।”
🚧 প্রকৃত বাস্তবতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, FASTag এবং ডিজিটাল টোল আদায় ব্যবস্থার ফলে যে রাজস্ব বেড়েছে তা ইতিবাচক, কিন্তু এর ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্বিনিয়োগের স্বচ্ছতা আরও প্রয়োজন। World Bank-এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে প্রাপ্ত টোল আয়ের মাত্র ৬০ শতাংশ রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়, বাকিটা যায় সরকার পরিচালিত অন্যান্য পরিকাঠামো প্রকল্পে।
যেখানে শুধু রাস্তা থেকেই সরকার দৈনিক ₹১৬৮.২৪ কোটি উপার্জন করছে, সেখানে জনগণের ন্যায্য প্রশ্ন— “এই অর্থ কি আমাদের নিরাপদ, উন্নত সড়কের জন্য ব্যবহার হচ্ছে?” সরকারের পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি। কারণ পরিকাঠামো উন্নয়ন মানেই শুধুমাত্র রাজস্ব আদায় নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জন—সেটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।