সিঙ্গুর আন্দোলনের (Singur factory controversy) প্রায় দেড় দশক পরে ফের উত্তাল রাজনৈতিক জল। সিপিআইএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য শনিবার ফেসবুকে এক বিস্ফোরক পোস্ট করে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলেন। তাঁর বক্তব্য, সিঙ্গুরের মোটরগাড়ি প্রকল্প গুজরাটে সরিয়ে নেওয়ার পিছনে ছিল বিজেপি, মাওবাদী, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যৌথ উদ্যোগ। এই পরিকল্পনার ফলেই সিঙ্গুর আজ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আর গুজরাটের সানন্দ হয়ে উঠেছে শিল্পের উজ্জ্বল কেন্দ্র।
বিকাশরঞ্জনের কথায়, “সিঙ্গুরের মোটর গাড়ির কারখানা গুজরাটের হাতে তুলে দিতে যৌথ উদ্যোগ নিয়েছিল বিজেপি-মাওবাদী-তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, নেতৃত্বে মমতা। আজ সিঙ্গুরে সর্ষে চাষও হয় না অথচ অখ্যাত সানন্দ (গুজরাট) ঝলমলে শহর।”
দীর্ঘমেয়াদী ও তাৎক্ষণিক ক্ষতি
সাংসদের দাবি, সিঙ্গুর আন্দোলন শুধু শিল্প হারানোর কারণ নয়, এর প্রভাব বহুস্তরে পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদে এলাকার কৃষি ও শিল্প—দুটোই ধাক্কা খেয়েছে। শিল্প না থাকায় কর্মসংস্থান কমেছে, চাষের জমি আগের উৎপাদনশীলতা হারিয়েছে। তাঁর কথায়, “এটা দীর্ঘকালীন ক্ষতি। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে ছিল এক বিশাল তাৎক্ষণিক ক্ষতির বোঝা।”
তিনি হিসেব কষে জানান, আন্দোলনের পর রাজ্য সরকারকে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। টাটা গোষ্ঠীকেও ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয়েছে প্রায় ৭৬৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে আদালতে মামলার জন্য আরও কয়েকশো কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে এই অর্থনৈতিক বোঝা পড়েছে রাজ্যের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে।
রাজনৈতিক ইঙ্গিত
বিকাশরঞ্জনের পোস্ট শুধু অর্থনৈতিক দিক নয়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরে। তাঁর মতে, সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল এক কৌশলগত রাজনৈতিক চাল, যার মাধ্যমে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারকে দুর্বল করে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটানো হয়। তিনি অভিযোগ করেন, তৃণমূলের নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনে মাওবাদী গোষ্ঠী ও বিজেপি—দুই বিপরীত মতাদর্শের শক্তির সমন্বয় ঘটেছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই—বামফ্রন্টকে সিংহাসনচ্যুত করা।
সিঙ্গুর বনাম সানন্দ
২০০৮ সালে টাটা মোটরস তাদের ন্যানো প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে গুজরাটের সানন্দে সরিয়ে নেয়। সেই সময়ে সানন্দ ছিল তুলনামূলকভাবে অপরিচিত একটি শহর। কিন্তু সিঙ্গুরে প্রকল্প বাতিল হওয়ার পর সানন্দ দ্রুত শিল্পনগরীতে পরিণত হয়। টাটার ন্যানো কারখানার পাশাপাশি সেখানে আরও বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে, ফলে কর্মসংস্থান ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি হয়।
অন্যদিকে, সিঙ্গুরের জমি মামলার পরে ফের কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হলেও, বহু জমি আর আগের মতো চাষযোগ্য অবস্থায় নেই। বিকাশরঞ্জনের বক্তব্যে সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন—তিনি দাবি করেন, আজ সিঙ্গুরে এমনকি সর্ষের চাষও হয় না।
প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক
বিকাশরঞ্জনের এই মন্তব্য রাজনৈতিক মহলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস এখনও সরাসরি প্রতিক্রিয়া না দিলেও, দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তাঁরা এই অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছে। তৃণমূল নেতাদের মতে, সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল কৃষকদের জমি রক্ষার ন্যায়সঙ্গত লড়াই, যা শেষ পর্যন্ত আদালতও সমর্থন করেছে।
বিজেপির তরফ থেকেও বিকাশরঞ্জনের অভিযোগ নিয়ে তেমন সাড়া মেলেনি, তবে অনেকে মনে করছেন, তাঁর এই মন্তব্য সিঙ্গুর আন্দোলনের নতুন করে রাজনৈতিক মূল্যায়নের পথ খুলে দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক মূল্য বনাম রাজনৈতিক লাভ
বিকাশরঞ্জনের বক্তব্য মূলত একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে—রাজনৈতিক লাভের জন্য কি রাজ্যের শিল্পোন্নয়নের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল? সিঙ্গুর আন্দোলনের ফলে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি, কিন্তু সেই পরিবর্তনের খেসারত আজও সাধারণ মানুষ দিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।
তিনি ফেসবুক পোস্টের শেষে লেখেন, “এইসব ক্ষতিপূরণ করা হবে জনসাধারণের ঘাড় ভেঙে। ভাবুন। ভাবতে শিখুন।” তাঁর এই আহ্বান স্পষ্টতই রাজ্যের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে, যাতে তাঁরা রাজনৈতিক ঘটনার পিছনের অর্থনৈতিক বাস্তবতাও উপলব্ধি করতে পারেন।
সিঙ্গুরের ঘটনা এখনও বাংলার রাজনীতির এক সংবেদনশীল অধ্যায়। বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক মন্তব্য সেই পুরনো ক্ষতকে আবারও উন্মোচন করেছে। একদিকে রয়েছে তৃণমূলের জমি রক্ষার আন্দোলনের ঐতিহাসিক দাবি, অন্যদিকে বিকাশরঞ্জনের অভিযোগে উঠে আসছে এক ভিন্ন কাহিনি—যেখানে আন্দোলনের আড়ালে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাব লুকিয়ে আছে।
এই বিতর্ক যে এখানেই থামবে না, তা রাজনৈতিক মহলের সকলে বুঝে গিয়েছেন। সিঙ্গুর বনাম সানন্দের এই তুলনা আগামী দিনে রাজ্য রাজনীতির মঞ্চে ফের বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।