ভারতীয় সংসদ (Parliament) বুধবার ‘ব্যাঙ্কিং আইন (সংশোধনী) বিল ২০২৪’ অনুমোদন করেছে, যা দেশের ব্যাঙ্কিং নিয়মে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বুধবার লোকসভায় এই বিলটি উত্থাপন করেন। এই বিলের মাধ্যমে সরকার ব্যাঙ্কগুলোর শাসন মান উন্নত করতে এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) কাছে রিপোর্টিংয়ে সামঞ্জস্য আনতে চায়। এছাড়াও, এই সংশোধনী আমানতকারী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্নত সুরক্ষা এবং সরকারি ব্যাঙ্কগুলোর পরিষেবার মান বাড়াতে কাজ করবে।
বিলের প্রধান বিষয়:
এই বিলে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হল সমবায় ব্যাঙ্কের পরিচালকদের (চেয়ারপার্সন ও পূর্ণকালীন পরিচালক ব্যতীত) মেয়াদ বাড়ানো। বর্তমানে তাঁদের মেয়াদ ৮ বছর, যা এখন ১০ বছর করা হবে। এই পরিবর্তন সংবিধানের (সাতানব্বইতম সংশোধনী) আইন, ২০১১-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে করা হচ্ছে। এছাড়াও, বিলটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চারজন পর্যন্ত নমিনি নিয়োগের সুবিধা দেবে এবং অদাবিকৃত আমানত ব্যবস্থাপনার জন্য নতুন নিয়ম আনবে।
বিলের ওপর জবাব দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেন, “এই ব্যাঙ্কিং আইন (সংশোধনী) বিল পাঁচটি ভিন্ন আইনের ওপর প্রভাব ফেলবে, যা এটিকে অনন্য করে তোলে। এটি আরও অনন্য কারণ আটটি ভিন্ন দল এই সংশোধনীগুলো নিয়ে কাজ করেছে, যাতে বাজেট ভাষণে উল্লেখিত উদ্দেশ্য পূরণ করা যায়।”
তিনি জানান, এই পাঁচটি আইন হল: (১) রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া আইন, ১৯৩৪, (২) ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন আইন, ১৯৪৯, (৩) স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া আইন, ১৯৫৫, (৪) ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ (অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর) আইন, ১৯৭০, এবং (৫) ব্যাঙ্কিং কোম্পানিজ (অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর) আইন, ১৯৮০।
ব্যাঙ্ক জালিয়াতির বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ:
নির্মলা সীতারামন জানান, কেন্দ্রীয় সরকার ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি বলেন, “২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ED) ব্যাঙ্ক জালিয়াতি সংক্রান্ত প্রায় ৯১২টি মামলা হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির কেসও রয়েছে।” এই মামলাগুলোতে প্রায় ৪৪,২০৪ কোটি টাকার অপরাধমূলক সম্পদ বাজেয়াপ্ত, জব্দ বা ফ্রিজ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আটটি মামলায় ২২,২৭৬ কোটি টাকার সম্পদ ব্যাঙ্ক, বৈধ দাবিদার বা মানি লন্ডারিংয়ের শিকারদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছে। মোট ১৪৪ জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ২৩৯টি প্রসিকিউশন অভিযোগ, যার মধ্যে ৬৬টি সম্পূরক অভিযোগ, বিশেষ আদালতে দায়ের করা হয়েছে। এছাড়াও, ২৩ জনকে পলাতক অপরাধী ঘোষণা করা হয়েছে এবং ৯ জন প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং আইনের (PMLA) অধীনে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত, ৯ জন ব্যক্তিকে পলাতক অর্থনৈতিক অপরাধী (FEO) ঘোষণা করা হয়েছে এবং ৭৪৯.৮৩ কোটি টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করছে।
জনধন অ্যাকাউন্ট ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি:
অর্থমন্ত্রী জনধন অ্যাকাউন্টের সাফল্যের কথা তুলে ধরে বলেন, “এখন পর্যন্ত ৫৫ কোটি জনধন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, যার ৫৫ শতাংশ মহিলাদের নামে।” তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (DPI) ব্যবহার করে ভারত ৮০ শতাংশের বেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অন্তর্ভুক্তি অর্জন করেছে। প্রথাগত পদ্ধতিতে এই কাজে ৪৭ বছর লাগত।
বিলের বিস্তারিত পরিবর্তন:
এই বিলে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন রয়েছে। ব্যাঙ্কগুলোর নিয়ন্ত্রক সম্মতি রিপোর্টিংয়ের তারিখ দ্বিতীয় ও চতুর্থ শুক্রবারের পরিবর্তে প্রতি মাসের ৫ তারিখ ও শেষ দিনে নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চারজন পর্যন্ত নমিনি নিয়োগের সুবিধা দেওয়া হবে, যা আমানতকারীদের জন্য সুবিধাজনক। সমবায় ব্যাঙ্কের একজন পরিচালক এখন কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে রাজ্য সমবায় ব্যাঙ্কের বোর্ডে কাজ করতে পারবেন। ব্যাঙ্কগুলোকে স্ট্যাটিউটরি অডিটরদের পারিশ্রমিক নির্ধারণে বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
পশ্চিমবঙ্গে সমবায় ব্যাঙ্ক ও সরকারি ব্যাঙ্কের একটি বড় গ্রাহক ভিত্তি রয়েছে। এই সংশোধনী গ্রামীণ এলাকায় সমবায় ব্যাঙ্কের পরিচালকদের দীর্ঘ মেয়াদে কাজ করার সুযোগ দেবে, যা স্থানীয় শাসনকে শক্তিশালী করতে পারে। একই সঙ্গে, জনধন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর প্রভাব রাজ্যে ইতিমধ্যে দৃশ্যমান।
‘ব্যাঙ্কিং আইন (সংশোধনী) বিল ২০২৪’ ব্যাঙ্কিং খাতে শাসন, স্বচ্ছতা এবং গ্রাহক সুবিধা বাড়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। জালিয়াতি রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ এবং জনধনের মতো উদ্যোগ দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করছে। বাঙালি গ্রাহকদের জন্য এটি একটি নিরাপদ ও উন্নত ব্যাঙ্কিং অভিজ্ঞতার পথ প্রশস্ত করবে।