মধ্যপ্রদেশ সরকার রাজ্যের অবকাঠামো উন্নয়নে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার ঘোষণা করেছে। নতুন নাগরিক বিমান চলাচল নীতি–২০২৫ ( Madhya Pradesh aviation policy) অনুযায়ী, রাজ্যে প্রতি ১৫০ কিলোমিটার অন্তর একটি বিমানবন্দর এবং প্রতি ৭৫ কিলোমিটার অন্তর একটি এয়ারস্ট্রিপ গড়ে তোলা হবে। সরকারের দাবি, এই পদক্ষেপ রাজ্যের যাতায়াত ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন আনবে এবং একই সঙ্গে পর্যটন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
বিমানবন্দর বিস্তারের রূপরেখা
বর্তমানে মধ্যপ্রদেশে ভোপাল, ইন্দোর এবং গ্বালিয়রের মতো শহরে আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর সচল রয়েছে। সাম্প্রতিক সাফল্যের উপর ভর করেই এবার সরকার শিবপুরী ও উজ্জয়িনীতে নতুন বিমানবন্দর গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যেই উভয় জেলায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকারি অনুমান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে রাজ্যে বিমান যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৭৫ লক্ষে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের ৫৫ লক্ষ যাত্রীর তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি।
পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
পর্যটন শিল্পে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উজ্জয়িনী, খাজুরাহো, সাঁচি কিংবা ভোপালের মতো ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড় বাড়তে পারে। পাশাপাশি, স্থানীয় কৃষিজ পণ্য ও হস্তশিল্প দ্রুত পরিবহন সম্ভব হলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রও প্রসারিত হবে। সরকারের দাবি, নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তবে প্রশ্নও উঠছে। ২০২২ সালে Journal of Transport Geography-তে প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, শিল্পোন্নয়ন ছাড়া গ্রামীণ বিমানবন্দরগুলি সচল রাখা প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, কেবল অবকাঠামো তৈরি করলেই যথেষ্ট হবে না; শিল্প ও ব্যবসার প্রসার ঘটাতে না পারলে বিমানবন্দরগুলির আয়ুষ্কাল দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
প্রশাসনিক বৈপরীত্য ও সমালোচনা
এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার বিপরীতে, রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রশাসনিক অব্যবস্থার চিত্রও উঠে এসেছে। এনডিটিভি–র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু হোশাঙ্গাবাদ ও হারদা জেলা মিলিয়েই প্রায় ৩ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য খোলা জায়গায় পচে যাচ্ছে। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টা সচিন জৈনের তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যে প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে তিনজনই অপুষ্টিতে ভুগছে। এই বাস্তবতার মধ্যে বিমানবন্দর তৈরিতে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করা কতটা ন্যায্য, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন সমালোচকরা।
সরকারের যুক্তি
রাজ্যের শাসকদল বিজেপির দাবি, “ডবল ইঞ্জিন সরকার”—অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্যে একসঙ্গে একই দলের সরকার থাকার কারণে মধ্যপ্রদেশ অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় তহবিল ও নীতিগত সহযোগিতার ফলে এই বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে। তাঁদের মতে, বিমানবন্দর অবকাঠামো শুধু যাতায়াত উন্নত করবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পর্যটনকেও গতিশীল করে তুলবে।
সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ
স্থানীয়রা অবশ্য ভিন্ন সুর তুলছেন। একদল মানুষ মনে করছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে গ্রামীণ অঞ্চলে উন্নয়ন ঘটবে, কৃষিজ পণ্যের বাজারজাতকরণ সহজ হবে। অন্যদিকে, কিছু মানুষ মনে করছেন, প্রাথমিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। শিবপুরীর এক কৃষকের কথায়, “আমাদের ধান যদি পচে যায়, তাহলে বিমানবন্দর দিয়ে কী হবে?”
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ। একটি বিমানবন্দর নির্মাণে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়, পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। তাছাড়া, যদি পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়া যায় তবে এই বিমানবন্দরগুলি বোঝায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রকল্প সফল করতে হলে শিল্প বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিতে হবে।
মধ্যপ্রদেশ সরকারের নতুন বিমাননীতি নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। এটি রাজ্যের চেহারা বদলাতে পারে, বিশেষত যদি শিল্পোন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে খাদ্যশস্য অপচয় ও শিশুপুষ্টির সংকটের মতো সমস্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে এই পরিকল্পনা অনেকের কাছেই এক বৈপরীত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায়, আকাশপথে উন্নয়নের স্বপ্ন যতটা উজ্জ্বল, মাটির সমস্যাগুলো সমাধান না করলে তার ভিত্তি ততটাই নড়বড়ে থেকে যাবে।