নিজের বাড়ির স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অনেকেই গৃহঋণের (Home Loan) আশ্রয় নেন। তবে, প্রথমবারের মতো এই প্রক্রিয়ার সম্মুখীন হলে বিষয়টি যথেষ্ট জটিল ও বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। ঋণের আবেদন থেকে অর্থ ছাড় হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে পুরো প্রক্রিয়াটি অনেক সহজ ও সাবলীল হয়ে ওঠে।
চলুন জেনে নেওয়া যাক, কীভাবে একটি গৃহঋণের আবেদন করতে হয়, এবং তার সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলি।
গৃহঋণের প্রাথমিক আবেদন ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র:
গৃহঋণের যাত্রা শুরু হয় আবেদনপত্র পূরণ করার মাধ্যমে। এই আবেদনপত্রের সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জমা দিতে হয়, যেমন:
পরিচয় প্রমাণ (প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ভোটার আইডি)
ঠিকানার প্রমাণ (ইলেকট্রিসিটি বিল, রেশন কার্ড)
আয় সংক্রান্ত নথি (সেলারি স্লিপ, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট)
কর্মসংস্থানের প্রমাণ (চাকুরিজীবীদের জন্য নিয়োগপত্র বা কোম্পানির সার্টিফিকেট, ব্যবসায়ীদের জন্য GST রেজিস্ট্রেশন বা ট্রেড লাইসেন্স)
যদি কোনও সহ-আবেদনকারী (co-applicant) থাকেন, তবে তাঁর ক্ষেত্রেও একই নথিপত্র জমা দিতে হয় এবং আবেদনপত্রে দু’জনকেই স্বাক্ষর করতে হয়।
যাঁরা ইতিমধ্যেই একটি সম্পত্তি চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সেই সম্পত্তি সম্পর্কিত নথিপত্র (চুক্তিপত্র, টাইটেল ডিড ইত্যাদি) জমা দিতে হয়, যাতে ঋণদাতা সংস্থা আইনি ও টেকনিক্যাল যাচাই দ্রুত শুরু করতে পারে।
ক্রেডিট অ্যাপ্রেইজাল ও যোগ্যতা নির্ধারণ:
আবেদন পাওয়ার পরে, ঋণদাতা সংস্থা আবেদনকারীর আর্থিক প্রোফাইল যাচাই করে দেখে যে তিনি ঋণ নেওয়ার যোগ্য কি না। এই যাচাইয়ের মূল মাপকাঠিগুলি হল:
মাসিক ও বার্ষিক আয়
বিদ্যমান ঋণ ও ক্রেডিট স্কোর
চাকরির স্থায়িত্ব ও আবেদনকারীর বয়স
নির্ভরশীল সদস্যদের সংখ্যা
সহ-আবেদনকারীর আর্থিক অবস্থান (যদি প্রযোজ্য হয়)
যাঁরা স্বনিযুক্ত (self-employed), তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যবসার লাভজনকতা, টার্নওভার, ক্যাশ ফ্লো ইত্যাদির উপর অতিরিক্ত বিশ্লেষণ করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ফিল্ড ভেরিফিকেশন বা স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করা হয়।
ঋণ মঞ্জুরপত্র ও শর্তাবলী জানানো:
যদি আবেদনকারী যোগ্য বলে বিবেচিত হন, তবে ঋণদাতা একটি ‘সাংশলন পত্র’ বা Sanction Letter প্রদান করে। এতে সাধারণত উল্লেখ থাকে:
অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ
সুদের হার (স্থির বা পরিবর্তনশীল)
ঋণ পরিশোধের মেয়াদ
প্রতি মাসে EMI-এর পরিমাণ
অর্থ ছাড়ের আগে পূরণযোগ্য শর্তাবলি
প্রস্তাবের মেয়াদসীমা
এই সাংশলন পত্র মূলত সম্পত্তির আইনি ও টেকনিক্যাল যাচাই সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার শর্তে কার্যকর হয়।
আইনি ও প্রযুক্তিগত যাচাই:
এই পর্যায়ে আবেদনকারীকে সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র জমা দিতে হয়, যেমন:
টাইটেল ডিড বা মালিকানার শৃঙ্খলা
বিক্রয় চুক্তিপত্র বা নির্মাতার সঙ্গে চুক্তি
কমপ্লিশন সার্টিফিকেট বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট
আবশ্যক হলে NOC বা অনাপত্তি পত্র
একজন টেকনিক্যাল অফিসার সম্পত্তির গঠনগত মান যাচাই করেন এবং বাজারমূল্য নির্ধারণ করেন। আইনি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেন যে সম্পত্তিতে কোনও আইনি জটিলতা বা বিতর্ক নেই।
ঋণ ছাড় ও চূড়ান্ত চুক্তি:
সব কিছু যাচাই-বাছাইয়ের পর ঋণদাতা সংস্থা চূড়ান্ত ঋণচুক্তি প্রস্তুত করে। এই চুক্তিতে ঋণের সমস্ত শর্তাবলি, সুদের হার, EMI-এর পরিমাণ, মেয়াদ ইত্যাদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে।
আবেদনকারীকে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয় এবং তারপর ঋণের অর্থ ছাড় করা হয়। যদি সম্পত্তিটি নির্মাণাধীন হয়, তবে প্রকল্পের অগ্রগতির ভিত্তিতে কিস্তিতে অর্থ ছাড় করা হয়।
সতর্কতা ও পরামর্শ:
চূড়ান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষরের আগে আবেদনকারীকে অবশ্যই নিম্নলিখিত বিষয়গুলি মনোযোগ দিয়ে পড়ে নেওয়া উচিত:
সুদের হার এবং তার ধরন
EMI-এর নির্দিষ্ট অঙ্ক
সম্পূর্ণ মেয়াদ ও পুনর্গঠন শর্তাবলি
লুকোনো চার্জ বা জরিমানা
সঠিক তথ্যের অভাব, তাড়াহুড়ো করে চুক্তি স্বাক্ষর, কিংবা EMI হিসেব না করে ঋণ নেওয়া ভবিষ্যতে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রতিটি ধাপে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
গৃহঋণ একটি দীর্ঘমেয়াদি দায়বদ্ধতা হলেও, সঠিক পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও ধাপে ধাপে সচেতনতা থাকলে এটি নিজের স্বপ্নের বাড়ি অর্জনের অন্যতম সহায়ক উপায় হতে পারে। তাই যারা প্রথমবার গৃহঋণ নিতে চলেছেন, তাঁদের জন্য এই গাইড পথপ্রদর্শকের মতো কাজ করতে পারে।